অথবা, ভারতবর্ষে লর্ড ডালহৌসির
শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন দিক তুলে ধর।
অথবা, ভারতবর্ষে লর্ড ডালহৌসির শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ব্যাখ্যা দাও।
উত্তর: ভূমিকা : ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অগ্রগতিতে যাদের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়। তাদের মধ্যে লর্ড ডালহৌসি প্রথম সারির একজন শাসক হিসেবে পরিচিত। তার শাসনকাল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের একটি স্মরণীয় অধ্যায়। তিনি ছিলেন লর্ড ওয়েলেসলির মতো একজন ঘোর সাম্রাজ্যবাদী। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তার সম্বন্ধে তার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। লর্ড ডালহৌসির সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি আলোচনা করতে গিয়ে স্যার রিচার্ড টেম্পল বলেন, “ইংল্যান্ড যে সকল বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভারত শাসনের জন্যে পাঠায়, তাদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসক হিসেবে কেউ কদাচিৎ ডালহৌসির সমকক্ষ হলেও তাকে অতিক্রম করতে পারেন নি।”
লর্ড ডালহৌসির সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি: ডালহৌসি সাম্রাজ্যবাদ নীতির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনটি পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে তার সাম্রাজ্যবাদ নীতি পরিচালিত হয়। নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. যুদ্ধাভিযান: ডালহৌসি পাঞ্জাবের শিখরাজ্য এবং ১৮৯২ সালে দ্বিতয়ি ব্রহ্ম যুদ্ধের দ্বারা ব্রহ্মদেশের অর্ন্তগত পেগু অধিকার করতে সক্ষম হন। সমগ্র পাঞ্জাব লর্ড ডালহৌসির করতলগত হলে সাম্রাজ্যের সীমান্ত আফগানিস্তানের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভকরে। সমগ্র ব্রহ্ম দেশ তার মাধ্যমে ইংরেজদের হস্তগত হয়।
২. স্বত্ব বিলোপ নীতি দ্বারা রাজ্য বিস্তার: সাম্রাজ্যবাদী লর্ড ডালহৌসি ছলে বলে কৌশলে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়ে তিনি যে কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করেছিলেন এদের মধ্যে তাঁর স্বত্ব বিলোপ নীতিই ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এই নীতি প্রয়োগ করে তিনি ১৮৪৮ সালে সাতারী রাজ্যটি, ১৮৫০ সালে সম্বলপুর, ১৮৫৩ সালে নাগপুর, ঝাঁসি এবং পরে উদয়পুর, জৈৎপুর কর্ণাট তাঞ্জোর রাজ্যগুলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
৩. কুশাসনের অজুহাতে দেশীয় রাজ্য দখল: লর্ড ডালহৌসি তার সাম্রাজ্য বিস্তারের তৃতীয় পন্থা হিসেবে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও কু-শাসনের অজুহাতে ১৮৫৩ সালে অযোধ্যা রাজ্যটিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। ডঃ এম.এন. সেন বলেন “অযোধ্যার নবাব পরিবারের প্রতি বর্বরোচিত ব্যবহার ও নিষ্ঠুর আচরণ ব্রিটিশ জাতির মর্যাদায় কলঙ্কলেপন করেছিল”। ব্রিটিশ সৈন্যের ব্যয়ভার বহনের টাকা বাকি পড়ায় হায়দ্রাবাদের নিজামের নিকট হতে বেরার প্রদেশটি কেড়ে নিয়ে তিনি তা ব্রিটিশ অধিকারভুক্ত করেন। সিকিম সরদার ব্রিটিশ কর্মচারীদের প্রতি দুর্ব্যবহার করেছেন অজুহাতে তিনি সিকিমের একটি অংশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
শাসন ব্যবস্থা: লর্ড ডালহৌসি শাসনব্যবস্থায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিলেন।
প্রথমত, বঙ্গদেশ শাসনের জন্যে লেফটেন্যান্ট গভর্নর বা ছোট লাট নিযুক্ত করেন।
দ্বিতীয়ত, তিনি কেন্দ্রীয় শাসন পরিষদ স্থাপন করেছিলেন। ভারতের জন্যে ভারত সরকার আইনক্ষেত্রে সর্বময় কর্তৃত্ব করতে থাকলেও স্থানীয় সরকারকে এতে অংশগ্রহণের আহ্বান করা যেত।
তৃতীয়ত, সমগ্র ব্রিটিশ ভারতকে জেলায় ভাগ করা হয় এবং জেলার রাজ্যকর্মচারীদের বিভাগীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
সংস্কারমূলক কাজ: ডালহৌসি শাসন ক্ষেত্রের প্রতিটি বিভাগে কিছু না কিছু সংস্কার সাধন করেন। নিম্নে তার সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো:
১. গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পুনঃনির্মাণ: আফগান নেতা শেরশাহের সময়ে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের নির্মাণ শুরু হয়। লর্ড ডালহৌসি সেই রোডের নির্মাণে সমাপ্তি ঘটান। এতে করে ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।
২. বিবাহ আইন: তিনি বিবাহ আইন পাস করে হিন্দু বিধবাদের পুনরায় বিবাহের ব্যবস্থা করেন এবং হিন্দু সমাজের অন্যান্য কুসংস্কার ও দোষত্রুটি দূর করেন।
৩. ডাক-বিভাগ: লর্ড ডালহৌসি দেশব্যাপী অর্ধআনা মূল্যের ডাক সরবরাহ করার ব্যবস্থা চালু করেন। তার পূর্বে দূরত্ব বুঝে ডাক সরবরাহ খরচ আদায় করা হতো।
৪. নারী শিক্ষার সম্প্রসারণ: লর্ড ডালহৌসি নারী শিক্ষারও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তার উৎসাহে এবং কাউন্সিলের সদস্য বেথুন সাহেবের চেষ্টায় কলকাতায় বেথুন মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫. বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ: ভারতীয় উপমহাদেশে তিনিই সর্ব প্রথম বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফের ব্যবস্থা চালু করেন। এর মাধ্যমে জরুরি সংবাদ খুব দ্রুত দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পাঠানো হতো।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, লর্ড ডালহৌসি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে মজবুত করে শাসনক্ষেত্রে স্থিতি ও শৃঙ্খলা আনয়ন করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে কেউ ছিলেন বিজেতা, কেউ গঠনকারী, কেউবা সংস্কারক। কিন্তু লর্ড ডালহৌসি ছিলেন একাধারে বিজেতা, গঠনকারী ও সংস্কারক।