উত্তর। ভূমিকা: তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত, সমাজসচেতন ও ছাত্রসমাজ ছিল মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির। মধ্যবিত্ত শ্রেণিই বাঙালির অধিকার ও দাবি আদায়ে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ছয়দফা ছিল মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রাণের দাবি। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ৬ দফা বাংলার শ্রমিক, কৃষক, মজুর মধ্যবিত্ত তথা আপামর মানুষের মুক্তির সনদ। এটা শোষকের ইচ্ছা হতে শোষিতে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিনিয়ে আনার হাতিয়ার। এটা মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধদের নিয়ে গঠিত বাঙালি জাতির স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ ও আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি ছয়দফার সংগ্রাম আমাদের জীবন মরণের সংগ্রাম। অতএব আওয়ামী লীগের ৬ দফা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই দাবি।
ছয়দফা কর্মসূচি মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্দোলন কি না : এ বিষয় আলোচনার পূর্বে শ্রেণি বলতে সাধারণত কি বুঝায় এবং কোন শ্রেণির মাধ্যমে ৬ দফা উত্থাপিত হয়েছিল সে সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন।
শ্রেণি: Marx এর মতে, শ্রেণি হলো ব্যক্তিসমষ্টি, যারা উৎপাদনের ব্যবহার, একই রকম কার্য করে ও অন্যান্য গ্রুপের সাথে সংঘাতময় চাপের মুখে পিষ্ট হয়। স্বতন্ত্রব্যক্তিরা এক একটি শ্রেণি তখনই গঠন করে, যখন তাদের একটি শ্রেণির বিরুদ্ধে সাধারণ সংগ্রাম চালাতে হয়। একটি শ্রেণি এভাবে ব্যক্তিসত্তার উর্ধ্বে উঠে স্বতন্ত্রসত্তার অধিকারী হয়। আর ব্যক্তির অধিকার, তার জীবনের সব সুযোগ সুবিধা ও ব্যক্তিগত উন্নতি তার শ্রেণি দ্বারা নির্ধারিত হয়।
অধ্যাপক ম্যাকাইভার ও পেজ তাঁদের ‘Society’ নামক গ্রন্থে বলেছেন যে, “শ্রেণি বলতে সমাজের এমন একটি বিশেষ অংশকে বুঝায়, যে অংশ সমাজের অবশিষ্ট অংশ থেকে স্বতন্ত্র।”
মাক্স ও এঙ্গেলসের মতে, প্রধান শ্রেণি দুটি। যথা:
১. শিল্পপতি বা (Bourgeois),
২. সর্বহারা বা (Proletariat)।
তবে তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তিনটি শ্রেণি লক্ষণীয়। যথা:
১. উচ্চবিত্ত শ্রেণি- Upper class
২. মধ্যবিত্ত শ্রেণি- Middle class
৩. নিম্নবিত্ত শ্রেণি-Lower class
এরা সমাজব্যবস্থায় পিরামিডের মতো বিস্তৃত। পিরামিডের ভূমিতে রয়েছে নিম্নশ্রেণি, তার উপরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং শীর্ষে রয়েছে উচ্চ শ্রেণি।
উপর্যুক্ত শ্রেণি বিশ্লেষণের প্রেক্ষাপটে আমরা বলতে পারি যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ২২টি পরিবার ছিল উচ্চবিত্ত শ্রেণির। এছাড়া প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, উচ্চ শিক্ষিত সরকারি আমলা, ডাক্তার, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ট্রেডইউনিয়নের নেতা, ভূ-স্বামী ছোট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক প্রভৃতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির আওতাভুক্ত। আর যারা জীবিকানির্বাহের জন্য মোটামুটি কষ্টসাধ্য করে থাকে তাদেরকে নিম্ন শ্রেণি বলা হয়।
৬ দফার প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ: আওয়ামী লীগের ছয়দফা মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্দোলন ছিল। ছয়দফা বিশ্লেষণে তা স্পষ্টভাবে বুঝা যাবে। যেমন- প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় যে দাবি তোলা হয়েছিল তা মূলত রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের কথা, যাতে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি মর্যাদা সহকারে বাঁচতে পারে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল।
মুদ্রা ও অর্থসংক্রান্ত যে দফা ছিল সেটা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থ সম্পর্কিত। কেননা মুদ্রা প্রচার বন্ধ হলে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির আর্থিক উন্নতি হবে। বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত যে দফা ছিল তাতে পূর্ব বাংলার খুদে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণির লাভের দিকে লক্ষ্য রেখেই করা হয়েছিল।
আর শেষ দফায় প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠনের যে দাবি করা হয় তাতেও মধ্যবিত্ত শ্রেণি স্বার্থের দাবি। কেননা তৎকালীন সময়ে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি সামরিকবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী ও বিমান বাহিনীতে ছিল না বললেই চলে। সুতরাং সামরিক বাহিনীতে অধিকসংখ্যক লোক নিয়োগ করে পূর্ব বাংলাকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং এ দেশীয় এলিটদের রক্ষা করা।
তাছাড়া ছয়দফার কোন দাবিতেই ব্যাংক, বিমা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের কোন ইঙ্গিত ছিল না। এর কারণ ব্যাংক, বিমা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন। ছয়দফা কর্মসূচিতে সমাজতন্ত্রের কোন কথাই বলা হয়নি।
উপর্যুক্ত ব্যাখ্যা থেকে বুঝা যায়, ৬ দফা ছিল মূলত পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থরক্ষা, সম্পর্কিত দাবি। শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্গত। প্রত্যেক শ্রেণি তার স্বার্থের দিকে তাকায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের চরিত্রগত বিশ্লেষণে তারা ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। সুতরাং, এরা যেসব দাবিদাওয়া উত্থাপন করেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে তাদের শ্রেণির স্বার্থের জন্য।
ছ্যাদফার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদী দলে পরিণত হয় এবং ১৯৬৯-৭০ সালে তা পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন লাভ সফল হয়। উপরন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা সম্মোহনী শক্তি দ্বারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমর্থন ও সহযোগিতা লাভে বিশেষভাবে সহায়ক হয়। সর্বস্তরের জনগণ আওয়ামী লীগের ছয়দফা কর্মসূচি তথা পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয় মূলত ছয়দফা কর্মসূচির বিজয় এবং এটি যে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির দাবি তারই প্রত্যক্ষ ফসল। ১৯৭০ সালে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সদস্যের শ্রেণিগত চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকালেও এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তারা সবাই মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
অধ্যাপক রওনক জাহান তাঁর এক সমীক্ষায় দেখিয়েছেন যে, ২০৯ জন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের ৭৭ জন ছিলেন উকিল, ২৮ জন ছিলেন ডাক্তার, ৫০ জন ভূস্বামী বা কৃষক আর বাকি ৫৪ জন বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। যেমন- শিক্ষকতা, সাংবাদিক ইত্যাদি।
এ তথ্য থেকে বুঝা যায়, আওয়ামী লীগের নেতারা ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তাই তারা প্রত্যেকে নীতি ও আইন প্রণয়নে নিজেদের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করেন। ছয়দফা কর্মসূচি মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য নেয়া হয়েছিল।
যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত শ্রেণি জাতীয় সম্পদে তাদের ন্যায়সংগত হিস্যা লাভে ইচ্ছুক ছিল এবং তা আদায়ের জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল, কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানের বুর্জোয়া শ্রেণিকে তারা তাদের প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত করে। সংগত কারণেই তারা আওয়ামী লীগ এর ছয়দফাকে তাদের একমাত্র ত্রাণকর্তা বলে মনে করে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি যে, ৬ দফা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির দাবি। যদিও ৬ দফা কর্মসূচিতে কোথাও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়নি, কিন্তু আক্ষরিক অর্থে দেখলে ৬ দফা কর্মসূচির যথার্থ মূল্যায়ন হবে না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করার নিমিত্তেই ছয়দফা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।