তুমি কি মনে কর লাহোর প্রস্তাবে অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান ছিল? এ প্রস্তাব কি পাকিস্তান প্রস্তাব ছিল।

অথবা, লাহোর প্রস্তাবের অস্পষ্টতা সীমাবদ্ধতা আলোচনা কর। তুমি কি মনে কর এ প্রস্তাব কি পাকিস্তান প্রস্তাব ছিল?

উত্তর: ভূমিকা: লাহোর প্রস্তাব উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটি ছিল ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে মুসলিম আধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গৃহীত প্রস্তাবই লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত। তবে এ প্রস্তাবের কিছু অস্পষ্টতা ছিল। যা আমরা পরবর্তীতে দেখতে পাই। এসব প্রস্তাবে ছিল একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র হবে কিন্তু পরবর্তীতে অস্পষ্টতার ইঙ্গিত হিসেবে পাকিস্তানের নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে বলা হয়েছিল অঙ্গরাজ্যগুলো স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন হবে কিন্তু কোন অঙ্গরাজ্য সার্বভৌম হতে পারে না নিম্নে প্রশ্নালোকে আলোচনা উপস্থাপন করা হল।

লাহোর প্রস্তাবের অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা: ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক কর্তৃক ঘোষিত লাহোর প্রস্তাবে কিছু অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো:

১. শব্দ চয়নে অস্পষ্টতা : লাহোর প্রস্তাবের ধারাগুলো বিশ্লেষণ করলে কিছু অস্পষ্টতা ও স্ববিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। এখানে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। (Independent states) স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ এবং (Sovereign) সার্বভৌম এগুলো এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে প্রকৃত অর্থ উদ্ধার করা কঠিন। ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অঞ্চল নিয়ে কয়েকটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু একথা পরিষ্কার করে উল্লেখ করা হয়নি যে এই রাষ্ট্রগুলো পৃথকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে। নাকি রাষ্ট্রগুলো একটি মাত্র ফেডারেশন ধরনের রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, এতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্র কথাটিকে বহুবচনে In dependent State ব্যবহার করায় বাক্যাংশটি দুটি মুসলিম রাষ্ট্র- একটি ভারতবর্ষের উপর পশ্চিমাংশ এবং অপরটি পূর্বাংশ বুঝায়। এ থেকে বোঝা যায় যে লাহোর প্রস্তাব উপমহাদেশের মুসলিম আধ্যুষিত এলাকাগুলির পূর্ণ স্বাধীনতা চাওয়া হয়েছিল।

২. স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র: লাহোর প্রস্তাবে অখণ্ড রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ নেই। বরং দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায়- একটি উত্তর পশ্চিম ভারতে সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও কাশ্মীর নিয়ে। অপরটি উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশ ও আসামের সমন্বয়ে -এ দুটি রাষ্ট্রের অন্তর্গত প্রদেশগুলো স্বায়ত্তশাসিত হবে।

৩. পাকিস্তান রাষ্ট্র: ১৯৪৬ সালের এপ্রিলে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের আইনসভার কনভেশন অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে। জিন্নাহ রাষ্ট্রের এই বহুত্ববোধক (States) শব্দটিকে অসাবধনতাপ্রসূত ও ছাপার ভুল বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন পাকিস্তান একটি স্বতন্ত্র সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। সুতরাং এ প্রস্তাবে সর্ব প্রথম States এর বদলে state শব্দ যুক্ত হয়।

৪. সার্বভৌমতার অস্পষ্টতা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী অঙ্গরাজ্য স্বায়ত্তশাসিত হতে পারে। কিন্তু সার্বভৌম হতে পারে থাকে না একটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। অথচ লাহোর প্রস্তাবে যে লাহোর প্রস্তাবের প্রণেতাগণ উত্তর-পশ্চিম ভারতে ও উত্তর না। অঙ্গরাজ্য সার্বভৌমত্বের অধিকারী হলে এটা আর অঙ্গরাজ্য বলা হয়েছে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের অঙ্গরাজ্যগুলো স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন হবে। এই স্ববিরোধি ভাষা হতে বলা যায় ভারতে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সমন্বয়ে একটি রাষ্ট্র সমবায় গঠনের সুপারিশ করেছেন। অথবা আবুল হাশিমের মতানুসারে বলা যায় যে, লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়েছে উত্তর পশ্চিম এবং তাদের রাজ্যগুলো হবে পূর্ণস্বায়ত্তশাসিত।

৫. লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তানী প্রস্তাব কিনা: আমরা লাহোর প্রস্তাবের ধারাগুলো দেখতে পাই, ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছিল। এ প্রস্তাবের কোথাও একটি মুসলিম রাষ্ট্র কিংবা পাকিস্তান শব্দের উল্লেখ ছিল না। সুতরাং আমি মনে করি না এটি পাকিস্তান প্রস্তাব ছিল। কি কারণে এটি পাকিস্তান প্রস্তাব বলা হলো তার পক্ষে তৎকালীন কতগুলো ষড়যন্ত্র আমরা দেখতে পাই।

৬. পত্রিকা বা সংবাদ মাধ্যমের অপপ্রচার: লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর কিছু দিনের মধ্যেই কংগ্রেস প্রভাবাধীন পত্র-পত্রিকাগুলো পাকিস্তান প্রস্তাব’ শিরোনাম লীগের প্রস্তাবিত দাবি-দাওয়া প্রকাশ করে। গ্রেট ব্রিটেনের পত্র-পত্রিকাগুলোতেও পরবর্তী সময়ে লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে অবহিত করা হয়। এতে কংগ্রেস নেতাদের বিরুদ্ধে লাহোর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কংগ্রেস সামর্থিত পত্র-পত্রিকাগুলো মূলত সমালোচনাসূচক অর্থেই লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে অবহিত করে। কারণ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।

৭. লাহোর শব্দে যে প্রস্তাব তা একাধিক রাষ্ট্র: ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন যে, পাকিস্তান শব্দটি তার বা মুসলিম লীগ কর্তৃক আবিষ্কৃত কোন শব্দ নয়। তিনি বলেন যে, পাকিস্তান শব্দটি কিছু হিন্দু ও ব্রিটিশ পাকিস্তান নামেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে বেশি। জিন্নাহ আরো বলেন যে, কতদিনই বা, এত বড় শব্দ ব্যবহার করা যায়। এ জন্য তিনি মাত্র একটি শব্দে প্রস্তাবকে অভিহিত করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তার অর্থ জিন্নাহর কথায় এটাই বুঝায় যে, প্রস্তাবটিকে প্রথমে লাহোর প্রস্তাব নামে অবহিত হলেও তার মনে আসলে অখণ্ড পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল। তাই তিনি পত্র-পত্রিকার দোহাই দিয়ে পাকিস্তান প্রস্তাব কথাটিকে সমর্থন করেছিলেন। এসময় থেকে পাকিস্তান নামটি জনসাধারণের মধ্যে পরিচিতি হয়। কিন্তু তখন পাকিস্তান বলতে এক রাষ্ট্র বোঝা যায়নি, লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী একাধিক রাষ্ট্র বোঝাতো।

৮. ভুল ব্যাখ্যা প্রদান: ১৯৪০ সালে লাহোরে প্রস্তাবের পর থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাব বলতে একাধিক রাষ্ট্রের কথাই উল্লেখ করেছিলেন। এর পর থেকেই তিনি পাকিস্তান নামে এক রাষ্ট্রের কথা ব্যবহার করেন। এরপর ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জিন্নাহ ও গান্ধীর মধ্যে যে একটি পত্র বিনিময় হয়, তাতে জিন্নাহ প্রথম উল্লেখ করেন যে, যে অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি সে অঞ্চলে একটি মুসলিম রাষ্ট্রে গঠিত হবে। দুই অঞ্চলের প্রদেশগুলি সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে কি না জিন্নাহর কাছে গান্ধী এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। এর জবাবে গান্ধীকে তিনি জানান যে, প্রদেশগুলো সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে না, এগুলো পাকিস্তানের ইউনিট হবে। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পূর্ব বাংলা ও আসামের প্রয়োজনীয় ভৌগোলিক রদবদল করে এদের সমন্বয়ে পাকিস্তান গঠিত হবে। জিন্নাহ ১৯৪৫ সালের ৮ নভেম্বর এসোসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকা প্রতিনিধিকে বলেন যে, পাকিস্তান একটি যুক্তরাষ্ট্র হবে এবং এর প্রদেশগুলো স্বয়ং শাসনের অস্ট্রোলিয়ার মতো পাকিস্তানে অধিকারী হবে। আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্র হবে এবং মুদ্রা, জাতীয় প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য বিষয় যুক্তরাষ্ট্রীয় দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়া হবে। ১৯৪৬ সালে মূল লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে। স্টেটস শব্দের পরিবর্তে স্টেট শব্দ ব্যবহার করার পর লাহোর প্রস্তাব নামেই অবহিত হতে থাকে। লাহোর প্রস্তাব এক রাষ্ট্রের অর্থে ব্যবহার করে জিন্নাহ এতে মূলগত পরিবর্তন করে আর এ পরিবর্তনের পেছনে যেমন দলীয় কোন নিয়মতান্ত্রিক সমর্থন যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না নৈতিক ভিত্তিও। তবুও এ প্রস্তাবকে সামনে রেখেই ভারতের মুসলমান জনগণ মুসলিম জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়। এরই ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ নেতাদের প্রচেষ্টায় স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে প্রস্তাবটি করা হয়েছিল সেটা লাহোর প্রস্তাব নামেই খ্যাতি পেয়েছিল। তবে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি হিসাবে পরিকল্পনা করা হয় জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বকে। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে অবশ্যই বলতে হবে লাহোর প্রস্তাব করা হয়েছিল সেটি ছিল দ্ব্যর্থবোধক যা পরবর্তীতে অনেকেই পাকিস্তান প্রস্তাব বলে অবহিত করেছেন।