উত্তরঃ ভূমিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দখলদার বাহিনীর সহযোগী সংগঠন কর্তৃক ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধীদের কর্মকাণ্ড ও ভূমিকা ছিল অতি নিন্দনীয় ও ঘৃণ্য। বাঙালি জাতি দখলদার বাহিনীর সহযোগী সংগঠনগুলোকে পাকিস্তানপন্থি হিসেবে দেখে থাকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশপন্থি ও পাকিস্তানপন্থিদের ভূমিকা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। মুসলিম লীগের সহযোগী সংগঠন ও তথাকথিত ধর্মভিত্তিক দলগুলো পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা চালায়। অন্যদিকে, বাঙালি জাতীয়বাদে উজ্জীবিত জনতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির পক্ষে রায় প্রদান করে। ফলে নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তান বিভক্তি সুনির্দিষ্ট হয়ে পড়ে। এরূপ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করলে পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করতে শক্তিপ্রয়োগ শুরু করে। বাঙালিরা এ দমন অত্যাচার প্রতিহত করতে শুরু করে। যুদ্ধকালীন সময়ে হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য এ দেশীয় ধর্ম প্রধান রাজনৈতিক দল যেমন- জামায়েত ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামী ইসলাম, শাস্তি কমিটি, আল-বদর, আল-শামস্ ও রাজাকার বাহিনী প্রভৃতি বাহিনী গড়ে উঠে। এ সকল বাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহায়তা করার সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা ও নির্যাতনে লিপ্ত হয়।
দখলদার বাহিনীর সহযোগী সংগঠন কর্তৃক স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ড: ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে বাঙালিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আর এ হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করতে সৃষ্টি হয় আল-বদর, আল-শামস্, রাজাকার ও শান্তিকমিটি। নিচে এদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. শাস্তি কমিটি: ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা, ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ এবং সেনা, নৌ, ইপিআর, পুলিশ, আনসার প্রভৃতি বাহিনী ও সাধারণ জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুললে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ভয়াবহ রূপ গ্রহণ করে। বর্বর পাকবাহিনী নির্বিচারে বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত করার জন্য নুরুল আমিনের নেতৃত্বে গোলাম আজম ও খাজা খায়ের উদ্দীনসহ ১২ জনের একটি প্রতিনিধি দল ৪ এপ্রিল জেনারেল টিকা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকারিগণ নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। ৯ এপ্রিল ১০৪ সদস্য বিশিষ্ট নাগরিক শাস্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের পক্ষে যারা আছেন তাদের নিধন করা। তারা দেশব্যাপী গণহত্যা, ধর্ষণ, ধর্ষণে হানাদার বাহিনীকে সহায়তা প্রদান, জমি দখল, স্বাধীনতাকামী কামীদের ধরিয়ে দেওয়া, প্রয়োজনে হত্যা, লুট, ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া প্রভৃতি স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। শান্তি কমিটি কখনো হানাদার বাহিনীর সাথে যৌথভাবে, কখনো এককভাবে স্বাধীনতা বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়।
২. রাজাকার বাহিনী: ১৯৭১ সালের জুন মাসে রাজাকার বাহিনী অর্ডিন্যান্স জারি করেন জেনারেল টিক্কা খান। আনসার বাহিনী বিলুপ্ত করে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। অর্ডিন্যান্সে রাজাকার বাহিনীতে যারা ভর্তি হবে তাদের অস্ত্রশস্ত্র প্রদান করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ সুযোগে সারা দেশে সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানী, ধর্মান্ধ লোকেরা একটি প্রভাবশালী বাহিনীতে পরিণত হয়। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা ছিল তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সরকারের বিভিন্ন স্থাপনা পাহারা দেওয়া, মুক্তিবাহিনীর খোঁজখবর দেওয়া, সংখ্যালঘুদের উৎপাত, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নেওয়া ইত্যাদি কাজে রাজাকার বাহিনী লিপ্ত ছিল। রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানের পক্ষে শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠে পূর্ব পাকিস্তানে। শরণার্থীদের সর্বস্ব লুট, যুবতী মেয়েদের আটক রেখে ধর্ষণ, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া ছিল রাজাকার বাহিনীর অন্যতম কাজ।
৩. আল-বদর: পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা, নির্মমভাবে হত্যা, নির্যাতন ছিল আল-বদর বাহিনীর কাজ। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে আল-বদর বাহিনী আত্মপ্রকাশ করে। মূলত জামায়েত ইসলামীর ছাত্র সংগঠন আল-বদরে রূপান্তরিত হয়। মতিউর রহমান নিজামী ছিল আল-বদর বাহিনীর প্রধান। আল-বদররা দুষ্কৃতিকারী দমনের নামে হত্যা শুরু করে। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ভূমিকায় ছিল আল-বদর বাহিনী। ডিসেম্বরের শেষ দিকে আল-বদর বাহিনী পরিকল্পিতভাবে লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার, সমাজসেবীদের আল-বদর বাহিনী বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে রায়েরবাজার ও ধানমন্ডির বিভিন্ন এলাকা, কচুক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থানে গর্ত করে নির্বিচারে এদের হত্যা করে। এ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় জঘন্যতম ও ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত ছিল।
৪. আল-শামস্ বাহিনী : মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যতম দোসর ছিল আল-শামস বাহিনী। ১৯৭১ সালে বিহারী সম্প্রদায় নিয়ে আল-শামস্ বাহিনী গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিহারী সম্প্রদায় পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন প্রদান করে ফলে পাকিস্তানি বাহিনী বিহারীদের অস্ত্র হাতে তুলে দেয়। আল-শামস্ বাহিনী অস্ত্র নিয়ে বাঙালি হত্যায় মেতে উঠে। বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, যারা শরণার্থী তাদের সম্পদ লুটপাট করে। মেধাবী ছাত্র, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষকদের তারা ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করত।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানের সহযাগী সংগঠন হিসেবে আল-বদর, আল-শামস্, রাজাকার ও শান্তি কমিটির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত ঘৃণ্য। এদের সাহায্য ও সহযোগিতার ফলেই পাকবাহিনী বিপুলসংখ্যক গণহত্যা। ও ধর্ষণ করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাস্তাঘাট ও জনপদ সম্পর্কে তেমন আন ছিল না। এছাড়া যুবতী নারী ও কন্যাদের খবরও তাদের কাছে ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনীর পথ দেখানো, মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেওয়া ও যুবতী নারীদের ধরে নিয়ে হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিত এ সংগঠনগুলো। মুক্তিযুদ্ধে তাদের কর্মকাণ্ড ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক ও আতম্ভের। তাদের কর্মকাণ্ড ছিল মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের শামিল। বাঙালি জাতি এ সকল সহযোগী সংগঠনকে ঘৃণা ভরে স্মরণ করে।