দায়িত্বশীল সরকার বলতে কী বুঝ? ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ব্রিটিশ ভারতের সরকারগুলো কতটুকু দায়িত্বশীল ছিল?

অথবা, দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থা কী? ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনে কী দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হত?

অথবা, দায়িত্বশীল সরকার সম্পর্কে কী জান? ব্রিটিশ সরকার দায়িত্বশীল ছিল?

অথবা সালে ভারত শাসন আইন অনুযায়ী কী

উত্তর: ভূমিকা: বর্তমানে প্রায় সকলের কাছে দায়িত্বশীল সরকার পদবাচ্যটি পরিচিত ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই ভারতবর্ষের জনগণ দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। অবশেষে ১৯১৭ সালের ২০ আগস্ট তৎকালীন ভারত সচিব ঘোষণা করেন ভারতে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। তার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক প্রশাসনে সীমিত আকারে দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি। তাই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে ব্রিটিশ ভারতের কেন্দ্র ও প্রদেশে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রচলনের পদক্ষেপ গৃহীত হয়।

দায়িত্বশীল সরকার: দায়িত্বশীল সরকার বলতে সেই সরকার ব্যবস্থা বুঝাবে যে সরকার তার সকল কার্যাবলির জন্য প্রত্যক্ষভাবে দেশের আইনসভার নিকট দায়ী থাকেন। সরকারের সকল ক্ষমতা তার মন্ত্রিপরিষদের হাতে ন্যস্ত থাকে। রাষ্ট্রপ্রধান শুধু নামেমাত্র শাসক থাকবেন। তিনি তার দায়িত্ব সর্বাবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে পরিচালনা করবেন। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে সীমিত আকারে দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে সেটাই বিবেচ্য বিষয়।

দায়িত্বশীল সরকারের বৈশিষ্ট্য: দায়িত্বশীল সরকারের তত্ত্ব বা বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:

১. রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন নামেমাত্র শাসক। তিনি সর্বাবস্থায় মন্ত্রিসভা ও প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে তার স্বীয় দায়িত্ব পালন করবেন।

২. শাসন বিভাগের সদস্য তথা মন্ত্রিগণ নিজ কর্মকাণ্ডের জন্য দেশের আইনসভার নিকট দায়ী থাকবেন।

৩. আইনসভার সদস্যরা মন্ত্রিসভার সদস্য হবেন। তবে তারা আইনসভার সমর্থন হারালে পদত্যাগ করতে বাধ্য থাকবেন।

৪. আইনসভার সদস্যগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। আইনসভার সদস্যরা সরকারের একটি বিভাগ হিসেবে জনগণের কাছে দায়ী থাকবেন।

৫. আইনসভার সমর্থন অসমর্থনের উপর মন্ত্রীদের কার্যাবলি নির্ভর করে।

৬. মন্ত্রীদের দৈনন্দিন কাজে রাষ্ট্রপ্রধান কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করেন না।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে ভারতের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলোর দায়িত্বশীলতা : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ব্রিটিশ ভারতের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসনে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ গৃহীত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়সমূহকে হস্তান্তরিত ও সংরক্ষিত এ দুই ভাগে ভাগ করে হস্তান্তরিত বিষয়গুলোর শাসনভার কেন্দ্রীয় পরিষদের হাতে অর্পণ করা হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদকে এর নীতি ও কার্যাবলির জন্য আইনসভার কাছে দায়ী করা হয়। আবার প্রদেশগুলোতে দায়িত্বশীল মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এ আইনে উল্লেখ করা হয় যে, প্রাদেশিক গভর্নর হবেন একজন নামেমাত্র শাসক। প্রদেশের প্রকৃত ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার হাতে। আইনসভার সদস্যদেরকে নিয়ে এ মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। অতএব তত্ত্বগতভাবে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসক আইন মোতাবেক ব্রিটিশ ভারতীয় প্রশাসনে। সীমিত আকারে হলেও দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু দায়িত্ব সরকারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতিগুলোর আলোকে বিচার করলে দেখা যায় যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী বৃটিশ ভারতের কেন্দ্রীয় কিংবা প্রাদেশিক প্রশাসনে প্রকৃতপক্ষে দায়িত্বশীল সরকার প্রবর্তিত হয়নি। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. গভর্নর জেনারেলের ভূমিকা: ১৯৩৫ সালের আইন অনুযায়ী একজন গভর্নর জেনারেল তার উপদেষ্টাবৃন্দ এবং একটি মন্ত্রিসভা নিয়ে ভারতের শাসন বিভাগ গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক বিষয়গুলোকে সংরক্ষিত এবং হস্তান্তরিত এ দুই ভাগে ভাগ করা হয়। সংরক্ষিত বিষয়গুলো পরিচালনার দায়িত্ব গভর্নর জেনারেল ও তাঁর উপদেষ্টাবৃন্দের উপর অর্পণ করা হয়। এসব বিষয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গভর্নর জেনারেল ও উপদেষ্টাগণ ভারতীয় কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে নয়; ভারত সচিবের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের কাছে দায়ী থাকেন। অন্যদিকে হস্তান্তরিত বিষয়গুলো গভর্নর জেনারেল ও তাঁর মন্ত্রিসভার হাতে অর্পিত হয়। এক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেল নামেমাত্র শাসক ছিলেন না। অর্থাৎ তিনি সবসময় মন্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করে হস্তান্তরিত বিষয়গুলোর শাসনকার্য পরিচালনা করতেন না। কোনো কোনো সময় তিনি মন্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করলেও তাদের ‘উপদেশ মাফিক দায়িত্ব পালন না করে বিশেষ দায়িত্ব এবং স্বীয় বিচার বুদ্ধিজনিত ক্ষমতাবলে মন্ত্রীদের উপদেশকে অগ্রাহ্য করে যে কোনো কার্য বা দায়িত্ব পালন করতেন। অতএব, গভর্নর জেনারেলের ভূমিকা এবং কার্যাবলি দায়িত্বশীল সরকারের মূলনীতিগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না বিধায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে ১৯৩৫ সালের আইন মোতাবেক দায়িত্বশীল সরকার বলা যায় না।

২. প্রাদেশিক গভর্নরের ভূমিকা: ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন মোতাবেক তত্ত্বগতভাবে ব্রিটিশ ভারতীয় প্রাদেশিক প্রশাসনে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত দায়িত্বশীল সরকার প্রবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রাদেশিক গভর্নরের ভূমিকা দায়িত্বশীল সরকারকে অর্থহীন করে তোলে। কেননা তিনি প্রদেশের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান ছিলেন। প্রাদেশিক শাসনভার প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদের হাতে অর্পণ করা হলেও মন্ত্রিগণ গভর্নর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন এবং তাঁরা যে কোনো সময় গভর্নর কর্তৃক বরখাস্ত হতেন। গভর্নর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা এবং স্বীয় বিচারবুদ্ধিজনিত ক্ষমতা প্রয়োগ করে মন্ত্রিসভার পরামর্শ উপেক্ষা করে যে কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। মন্ত্রিগণ যদিও প্রাদেশিক আইনসভার কাছে দায়ী থাকতেন, তথাপিও আইনসভার সমর্থন ও অসমর্থনের উপর মন্ত্রীদের কার্যকাল নির্ভর করত না। নিময় মাফিক গভর্নর মন্ত্রী সভাপতিত্ব করতেন যা দায়িত্বশীল সরকারের পরিপন্থি অ-কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলোতে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল না থাকায় গভর্ণর অসীম ক্ষমতা ভোগ করতেন। যেমন ১৯৪২ সালের অক্টোবর মাসে সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী আল্লাবক্সকে আইনসভার সমর্থন না থাকা সত্ত্বেও গভর্নর স্বৈরতান্ত্রিকভাবে বরখাস্ত করেন। ফলে সিদ্ধতে মন্ত্রিসভা অস্থিতিশীল হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত কেবলমাত্র ৫টি মন্ত্রিসভ্য সিন্ধুতেই উত্থান-পতন ঘটেছিল। দায়িত্বশীল সরকারের নিয়ম অনুযায়ী যদিও আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের নেতাকে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানানোর কথা কিন্তু উড়িষ্যা ও আসামের গভর্নর সংখ্যালঘুদের নেতাকে মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান জানান। এমনকি প্রাদেশিক নির্বাচনে পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও আসামের মুখ্যমন্ত্রী স্বপদে বহাল থাকেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রাদেশিক প্রশাসনে দায়িত্বশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

৩. বেসামরিক কর্মকর্তাদের ভূমিকা: ব্রিটিশ ভারতের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসনে নিযুক্ত বেসামরিক কর্মকর্তাদের ভূমিকা দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল। কেননা এসব কর্মকর্তাগণ ভারত সচিব কর্তৃক নিযুক্ত হতেন এবং তাদের কার্যাবলির জন্য ভারত সচিবের কাছে দায়ী থাকতেন। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার মধ্যে দিয়েই ভারত সচিব ভারতের প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। সুতরাং দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের অধীনে কাজ করার সময়ে তারা মন্ত্রীদেরকে মোটেই তোয়াক্কা বা গুরুত্ব দিতেন না। এসব কার্যকলাপ এবং ভূমিকা দায়িত্বশীল সরকারকে অর্থহীন করে তোলে।

৪. গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরের বিশেষ ক্ষমতা: ১৯৩৫ সালের আইন মোতাবেক গভর্নর জেনারেল কিংবা প্রাদেশিক গভর্নর যেমন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান ছিলেন না তেমনি ছিলেন না ক্ষমতাহীন বরং তাদের স্বীয় বিচার-বুদ্ধিজনিত ক্ষমতা এবং স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা অর্পণ করে স্বৈরাচারী শাসক হতে সহায়তা করা হয়। এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে তারা যথাক্রমে কেন্দ্রও প্রদেশগুলোতে প্রধানমন্ত্রী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগ ও আইনসভা কর্তৃক গৃহীত বিলে সম্মতি দান কিংবা ভোট প্রয়োগ করতে পারতেন। গভর্নর জেনারেল এবং গভর্নরগণ ছিলেন আইনসভার নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে।

৫. আইনসভাগুলোর ক্ষমতা: কেন্দ্রীয় কিংবা প্রাদেশিক আইনসভাগুলো আইন প্রণয়নকারী সর্বভৌম সংস্থা ছিল না। কেননা গভর্নর জেনারেল এবং গভর্নরগণ আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনে অবাধে ভোট প্রদান করতে কিংবা আইন পরিষদের যে কোনো বিলের আলোচনা স্থগিত করে দিতে কিংবা আইনসভাকে উপেক্ষা করে গভর্নর জেনারেল এবং গভর্নর আইনসভা কর্তৃক বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ হ্রাস বা বৃদ্ধি করতে পারতেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে যে দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থার কথা বলা হয় তা ছিল ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে এ কথা বলা হলেও আদৌ তা বাস্তবায়িত হয়নি। এখানে শুধু ঘোষণাই দেয়া হয় কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তবে ব্রিটিশ সরকারের এক্ষেত্রে পলিসি ছিল ভিন্ন ধরনের। পরিশেষে বলা যায়, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কেবল কাগজে কলমে পাস করা হয়।