দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আল গাজালির অভিযোগসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আল গাজালির প্রধান অভিযোগ কী ছিল?

অথবা, দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আল-গাজালর অভিযোগসমূহ বর্ণনা কর।

অথবা, দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আল-গাজালির অভিযোগসমূহ ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে মুসলিম জাহানের এক চরম সংকটময় মুহূর্তে আল গাজালির আবির্ভাব। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, দার্শনিক ও ধর্মীয় চিন্তাবিদ। দার্শনিক ও ধর্মীয় চিন্তাবিদ হিসেবে আল গাজালি মুসলিম দর্শনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দক্ষ শাসক ছিলেন। তিনি বিচক্ষণতা ও গভীর জ্ঞানের মাধ্যমে পূর্ববর্তী দার্শনিকদের ইসলামের পরিপন্থী মতবাদকে খণ্ডন করে ইসলাগকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। এজন্য তাকে হুজ্জাতুল ইসলামও বলা হয়।

আল গাজালির পরিচয়: ইমাম আল গাজালি ১০৫৮ সালে ইরানের খোরাসান নামক প্রদেশের অন্তর্গত তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম হচ্ছে আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে তাউস আহম্মদ আল তুলী আল শাফী আল নিশাপুরী। তিনি শৈশবেই তাঁর পিতাকে হারান। তাঁর পিতা ছিলেন ধার্মিক দরবেশ। অনেকের ধারণা তাঁর জন্মপল্লি গাজ্জাল এর নামানুসারেই তিনি গাজালি উপাধি ধারণ করেন। ‘কিমিয়ায়ে সালাত’, ‘ইয়াহ ইয়া-উল-উলুম-আদদীন’, ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’ প্রভৃতি তার বিখ্যাত গ্রন্থ।

দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আল গাজালির অভিযোগ: ইমাম আল গাজালি ইসলামি ভাবধারার অতান্ত শক্তিশালী অবস্থান করে নিয়েছেন। তাঁর চিন্তাধারা ও প্রভাব সমগ্র পাশ্চাত্যে এমনকি খ্রিস্টান ও ক্রিশ্চান চিন্তাধারায়ও প্রভাব বিস্তার করেছে। পাশ্চাতা, আধুনিক ও ইউরোপীয় দর্শনে আল গাজালি একটি অবিস্মরণীয় নাম। তিনি সর্বপ্রথম ‘মাকসিদুল ফালাসিফা’ নামক গ্রন্থটি প্রণয়ন করেন গ্রিক দর্শনের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’য় ২০টি বিষয়ে দার্শনিক মতবাদ অত্যন্ত সুন্দরভাবে আলোচনা ও পর্যালোচনা করেছেন। এ ২০টি বিষয়ের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দার্শনিক মতবাদ ছিল অসংগতি ও ভুলে পরিপূর্ণ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্ত ভুল না

হলেও যুক্তিসমূহ ভুল ছিল। ইমাম আল গাজালি ফালাসিফা সম্প্রদায়ের মুসলিম দার্শনিকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও অভিযোগ উত্থাপন করেন। তিনি তাঁর ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’ গ্রন্থে তিনটি মতবাদের উল্লেখ করেন। যথা:

১. জগতের অনাদিত্ব স্বীকার

২. আল্লাহর কোন বিশেষ জ্ঞান নেই এমন মনে করা।

৩. দৈহিক পুনরুত্থান অস্বীকার।

ইমাম আল গায়ালি ছিলেন গভীর চিন্তাশীল ব্যক্তি। তিনি অন্যান্য মুসলিম দার্শনিকদের কঠিনভাবে সমালোচনা করেন। তিনি তাদেরকে কাফের বলেও অভিহিত করেন। তিনি নিম্নলিখিত তিনটি কারণে তাদেরকে কাফের বলেছেন। যথা:

১. দার্শনিকরা জগৎকে অনাদি বলেছেন। তারা এও বলেছেন যে, জগতের যাবতীয় বস্তু অনাদি ও অবিনশ্বর।

২. দার্শনিকরা মনে করেন যে, আল্লাহ বিশেষকে জানেন না, সার্বিককে জানেন। তাদের প্রধান বক্তব্য ছিল খোদা আংশিক নিয়মাবলি সম্পর্কে অবগত নন।

৩. সার্শনিকরা দৈহিক পুনরুত্থান স্বীকার করেন না। তাদের মতে, পুনরুত্থান দৈহিক নয়, আত্মিক।

ইমাম আল গাজ্জালি দার্শনিকদের মতবাদসমূহ দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেন। তিনি
তাহাফাতুল ফালাসিফা’ গ্রন্থে যে অভিযোগগুলো উত্থাপন করেন তার মূল বক্তব্য হলো:

১. দার্শনিকদের মতবাদসমূহ ইসলামের মূলনীতি আকাইদের সাথে কিংবা শরিয়তের সাথে অসংগতিপূর্ণ।

২. দার্শনিকদের চিন্তাসমূহ নবী-রাসূল ও বিশ্বাসী ব্যক্তিদের মিথ্যাবাদী করে তুলেছে।

৩. গাজালির মতে, দার্শনিকরা যা বলতে চান তার মর্মার্থ হলো নবী-রাসূলগণ হয় নিজ থেকে এগুলোর বিরোধিতা করেছেন, নতুবা মানুষকে বুঝানোর জন্য এরূপ বলেছেন।

ইমাম আল গাজালি বলেছেন যে, দার্শনিকদের মধ্যে যে পদস্খলন ঘটেছে তা বিদআত বা অভিনবত্বের চেয়েও মারাত্মক। তিনি বলেন, যদি কেউ বিদআতীদের কাফের বলে অভিহিত করেন তাহলে দার্শনিকদেরও কাফের বলে গণ্য করতে হবে। সুতরাং গাজালি বলেন, দার্শনিকদের উপর্যুক্ত তিনটি কারণেই কাফের বলা হয়।

মন্তব্য: দার্শনিকগণ জগৎ ও জীবনের পরম সত্তা সম্পর্কে জানতে সব সময় নিজেদেরকে সক্রিয় রেখেছেন গাজালি যেসব দার্শনিকদের কাফের বলেছেন, তারা অধিকাংশই ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের প্রতি যথেষ্ট অনুরাগী ছিলেন। তারা সব সময় ইসলামের নিয়মকানুন মেনে চলতেন। তারা এমন যুক্তি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন যা ইসলামের নিয়ম কানুনের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। পবিত্র হাদিসে ইরশাদ করেছেন যে, “কোন মানুষ যেন কোন মানুষকে কাফের ও ফাসেক না বলে।” তাই তিনি দার্শনিকদের কাফের বলে তাদের প্রতি অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছেন।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, গাজালি তার মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দার্শনিকদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেন এবং তা খণ্ডন করেন তা সত্যিই দর্শনের ইতিহাসে বিরল। তিনি মূলত দার্শনিক অন্ধসংস্কারের বিরুদ্ধ ছিলেন না। তিনি দার্শনিক মতবাদের বিচারমূলক আলোচনা করেছেন। তিনি মুসলিম সমাজের নৈতিক আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় চিন্তার সংস্কার সাধনে অসামান্য অবদান রেখেছেন।