অথবা, এরিস্টটল কেন দাসপ্রথাকে সমর্থন করেছিলেন তা বর্ণনা কর।
অথবা, এরিস্টটল দাসপ্রথা সমর্থনের সকল যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তা বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: এরিস্টটল ছিলেন বহু প্রতিভার অধিকারী। জ্ঞানের রাজ্যে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। আনবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে তিনি করেছেন সমৃদ্ধ। তাঁর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক গ্রন্থ ‘The Politics & তিনি ক্রীতদাস প্রথার উপর এক অবিস্মরণীয় এবং বিচিত্র এক তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। রাষ্ট্রচিন্তায় এটি এরিস্টটলের। ‘দাসতত্ত্ব’ নামে পরিচিত। লক্ষণীয় যে, সমসাময়িক গ্রিক দার্শনিকদের প্রতি বিপরীত মত পোষণ করেও তিনি তার দাসতত্ত্বকে অধিকতর যুক্তিযুক্ত করে তোলেন।
দাসপ্রথার শ্রেণিবিভাগ: এরিস্টটল দাস শ্রেণিকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যথা: প্রকৃত দাস ও আইনগত বা প্রথাগত দাস। প্রকৃতিগত দাসরা ছিল সাধারণত জন্মভিত্তিক। আর আইনগত দাসপ্রথা হলো আইন বা প্রথার কারণে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়া। যেমন- যুদ্ধবন্দি হিসেবে ধৃত হয়ে দাসত্ব বরণ করা।
দাসপ্রথার পক্ষে যুক্তি: পৃথিবীতে সকল মানুষই শাসন করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। তাদের মধ্যে কেউ শাসন করার এবং কেউ শাসিত হওয়ার ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, এটাই প্রকৃতির বিধান। এরিস্টটলের মতে, “আত্মার নিকট যেমন দেহ, বুদ্ধির নিকট ক্ষুধা, মানবের নিকট পশু, পুরুষের নিকট নারী, পিতার নিকট সন্তান অধীনস্থ ঠিক তেমনি বুদ্ধি বিবর্জিত মানুষ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের অধীনস্থ।”
১. প্রকৃতির নিয়ম: সকল মানুষ সমান বুদ্ধি, মেধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা নেতৃত্বের গুণাবলি নিয়েই পৃথিবীতে আসে। আর বেশিরভাগ মানুষ জন্মে সেসব জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের আদেশ পালনের মানসিকতা নিয়ে, এটাই প্রকৃতির বিধান। কোন কাজে কেউ নেতৃত্ব দিবে, আর কেউ আনুগত্য করবে এটাই স্বাভাবিক। তাই এরিস্টটল বলেছেন, “জনগণ হতেই কেউ শাসন করার জন্য চিহ্নিত হয় এবং অন্যরা শাসিত হওয়ার জন্য।” তাই প্রকৃতির এ চিরন্তন বিধানের কারণে দাসপ্রথা অবশ্যম্ভাবী।
২. কর্মসম্পাদনের হাতিয়ার: এরিস্টটল দাসপ্রথাকে জীবন্ত সম্পদ এবং কর্মসম্পাদনের হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, “A slave is possession of his master and an instrument of action.” তাঁর মতে, যে ব্যক্তি অন্যের সম্পত্তিতে পরিণত হতে পারে সে দাস।
৩. প্রভুর সুবিধার্থে: এরিস্টটল মনে করেন যে, প্রভুদের কল্যাণার্থে দাসপ্রথা গ্রহণযোগ্য। রাষ্ট্র পরিচালনার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য প্রভু শ্রেণির অনেক সময় প্রয়োজন। যার দরুন তাঁরা দৈহিক পরিশ্রমের কাজগুলো করতে পারে না। ফলে শ্রম ও সময়ের অপচয় রোধ হবে।
৪. সাসদের মঙ্গলার্থে: এরিস্টটল বলেছেন, দাসপ্রথা বজায় থাকা দাসদের জন্য মঙ্গলময়। কারণ দাসরা দৈহিক শক্তিতে বলীয়ান ও বুদ্ধিহীন। দাসরা বুদ্ধি বিবেকসম্পন্ন প্রভুদের দাসবৃত্তি করে পরোক্ষভাবে তাদের গুণাবলি দ্বারা উপকৃত হয়। এরিস্টটল তাই দাসদের মঙ্গলার্থে দাসপ্রথার সমর্থন করেন।
৫. পরিবার গঠনের দিক থেকে: এরিস্টটল পরিবার গঠনের তিনটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেন। এগুলো হলো প্রভু-দাস, স্বামী-স্ত্রী এবং পিতা-সন্তান। পরিবার সৃষ্টির জন্য তিনি একজন পুরুষ ও একজন নারীকে যথেষ্ট মনে করেন নি। তার দৃষ্টিতে পরিবারে দাসের উপস্থিতি অপরিহার্য। তা না হলে পরিবার বেশিদিন সচল থাকবে না।
৬. স্বাভাবিক নীতি অনুসারে: এরিস্টটলের মতে, “স্বাভাবিক কারণেই উৎকৃষ্ট অংশ নিকৃষ্ট অংশের উপর আধিপত্য ও প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে।” কাজেই দাস শ্রেণি প্রভু শ্রেণির অধীনে কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক।
৭. রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনে: দাসপ্রথা বিদ্যমান থাকলে প্রভুগণ রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে অধিক সময় ব্যয় করতে পারবেন। প্রভুদের রয়েছে মানসিক বল এবং দাসদের রয়েছে দৈহিক ক্ষমতা। সংসার পরিচালনায় উভয়বিদ ক্ষমতার প্রয়োজন হয়।
৮. নাগরিকদের সুবিধার জন্য: দাস শ্রেণি পরিবারের সকল দৈহিক কাজ সম্পন্ন করে বিধায় প্রভু বা নাগরিকরা কাজের ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকে। ফলে প্রভুরা অবকাশ পায় এবং রাজনীতি ও দর্শনের মতো উচ্চতর বিষয়ে মনোনিবেশ করতে পারে।
৯. বাস্তবতার কারণে: বাস্তবে দেখা যায় যে, এক শ্রেণির লোক আর্থিক প্রজ্ঞা ও জানের অধিকারী এবং আর এক শ্রেণির লোক অধিকতর দৈহিক শক্তির অধিকারী। মানব প্রকৃতির এ বৈষম্য প্রভু ও দাস শ্রেণির অস্তিত্বের যথার্থতা প্রমাণ করে।
১০. দাসদের সীমাবদ্ধতা: এরিস্টটল দাস প্রভুদের বলেছেন, দাসদের উপর সবসময় সদয় ব্যবহার করবে এবং মুক্ত চিন্তার অবকাশ দিতে হবে। তিনি দাসপ্রথার উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, কোন ব্যক্তি তার দাসকে সম্পদ, শক্তি, আরাম আয়েশ এবং উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবে না।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, এরিস্টটল যদিও দাস প্রথাকে সমর্থন করেছেন এবং এর পিছনে যুক্তি দেখিয়েছেন তার পরও দাস প্রথা কোন কালেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে নি।