অথবা, আল-ফারাবি দেহ ও আত্মার সম্পর্ক বলতে কী বুঝিয়েছেন? আত্মার অমরত্বের প্রমাণে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা কর।
অথবা, আল-ফারাবির মতে দেহ ও আত্মার সম্পর্ক কিরূপ? তিনি কিভাবে আত্মরি অমরত্ব প্রমাণ করেন?
অথবা, দেহ ও আত্মার সম্পর্ক বিষয়ে আল-ফারাবির মতবাদ আলোচনা কর। তাঁর মতে আত্মা কী কারণে অমর।
উত্তরঃ ভূমিকা: আল-ফারাবির দর্শনের মূল লক্ষ্য হল ইসলামি শিক্ষাকে প্লেটো ও এরিস্টটলের দর্শনের সাথে সমন্বয় সাধন করা। তাঁর মতে, আত্মার বিশুদ্ধতা লাভ করাই হচ্ছে দর্শনের লক্ষ্য। তিনি বার্গসোঁ এর ন্যায় মনে করতেন যে, চিদাত্মার কল্পনা থেকে দেহধারী সত্তার উৎপত্তি। তিনি মানবজীবনের মূলতত্ত্ব বিশ্লেষণ, সমাজজীবনে তার প্রতিষ্ঠা, বাস্ত ব জীবনে তার প্রয়োগ, পরিণামে ইহজীবনে সুখ ও পরজীবনে সার্বিক শান্তি লাভ করার কথা বলেন।
দেহ ও আত্মার সম্পর্ক: দেহের সাথে আগ্রার সম্পর্ক নিবিড়। দেহের নিয়ন্ত্রক হল আত্মা। শরীরের সুস্থতাই হল স্বাস্থ্য। সদ্গুণ আত্মার উৎকর্ষ থেকে উৎপত্তি হয়। শরীর রোগাক্রান্ত বা শরীরের উপাদানগুলো অকেজো হলে যেমন ডাক্তারের প্রয়োজন, তেমনি আত্মার অবনতি হলে প্রয়োজন দক্ষ প্রশাসকের। জনসধারণের আত্মিক উন্নতিকল্পে দক্ষ প্রশাসক কাজ করে থাকেন। সাধনার মাধ্যমে মানুষ যখন আত্মিক উন্নতি লাভ করে, তখন দেহের চেয়ে আত্মার কথা অনুভূত হয় বেশি এবং পরিণামে খোদার নৈকট্য লাভ করে। আত্মা উন্নত স্তরে যখন উন্নীত হয় এবং পূর্ণতা লাভ করে তখন জড়পদার্থের উপর তার নির্ভরশীলতা কমে যায়।
আত্মার অমরত্বের প্রমাণ: আল-ফারাবির আত্মার অমরত্বের প্রমাণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. আত্যা মৌলিক পদার্থ, সুতরাং আত্মা অমর।
২. মানবজীবনের লক্ষ্য হল পরকালের সুখ। আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস না করলে সুখ দুঃখ অর্থহীন হয়ে পড়ে।
৩. আত্মার সম্পর্ক হল বৌদ্ধিক সদ্গুণ ও নৈতিক সদগুণের সাথে। মানুষের আত্মা নৈতিক ও বৌদ্ধিক পশুদের উৎকর্ষের মাধ্যমে খোদার তরফ থেকে অতীন্দ্রিয় শক্তি লাভ করে। অতীন্দ্রিয় সত্তার সাথে যে আত্মার সংযোগ যত বেশি, সে আত্মা তত বেশি সুখ লাভ করবে। মহৎ হল তাই যা মানুষের জন্য ইহজীবনে কল্যাণ ও পরজীবনে শান্তি বয়ে নিয়ে আসে। অন্যদিকে, যা কিছু মানুষের জন্য ইহজগতে অকল্যাণ নিয়ে আসে ও পরজগতের শান্তির অন্তরায় তাই অকল্যাণকর। এখানে মানুষের কল্যাণের জন্য সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাপী তিনি কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন। মানুষের আত্মিক উন্নতির সহায়ক হল কল্যাণকামী রাষ্ট্র। আত্মার উন্নতি বলতে তিনি ব্যক্তিগত আত্মার উন্নতির কথা বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, প্রতিটি মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে শান্তি লাভ। তিনি ‘তাহসিন আল সা’আদাহ’ গ্রন্থের শুরুতেই বলেছেন যে, প্রতিটি নাগরিক এবং প্রতিটি জাতি তাত্ত্বিক, বৌদ্ধিক, নৈতিক সদ্গুণ এবং ব্যবহারিক উৎকর্ষের মাধ্যমে ইহকালে সুখ ও পরকালে শান্তি লাভ করে। স্পষ্টভাবে এখানেও প্রতিটি নাগরিকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ফারাবি ‘মাদানিতুল ফাজিলা’ গ্রন্থে মৃত্যুর পরে আত্মার অবস্থান সম্পর্কে বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, মানুষের মৃত্যুর পর তাদের আত্মা এক এক করে একত্রিত হতে থাকবে। পবিত্র আত্মার সমাবেশ যেখানে যত বেশি হবে, তখন আত্মার আনন্দের মাত্রাও তত বর্ধিত হতে থাকবে। কুরআনের সে বাণী তাঁর এ বক্তব্য স্মরণ করে দেয়, যেখানে আল্লাহ আত্মাদেরকে সম্বোধন করে বলতে থাকবেন, “হে প্রশান্ত আত্মা, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের দিকে প্রত্যাবর্তন কর, তোমরা আমার আনুগত্য স্বীতার কর, ইবাদতে মগ্ন হও এবং জান্নাতে প্রবেশ কর।”
ফারাবি ‘ফুসুসল হেকাম’ গ্রন্থে আত্মার প্রতিশব্দ রুহ উল্লেখ করেছেন এবং রুহের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে বর্ণনা করেছেন যে, রুহ আলমে আমরা বা স্বাজিক জগতের সত্তা, তার কোন আকৃতি নেই এবং রুহ আলামুল মালাকুত। আল্লাহর নিকটে যে আত্মা বা রুহ আলম মালাকুত তাসবিহ পাঠ করে সে আত্মা মানুষের ব্যক্তিগত আত্মা হওয়াই স্বাভাবিক।
পরকালের জীবনের জন্য এ দুনিয়া কর্মস্থল। যে যেমন কাজ করবে পরকালে তেমন প্রতিফল পাবে। মর্যাদাপূর্ণ সংগঠন ও কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ইহলৌকিক সুখ ও পারলৌকিক শাস্তি অর্জন। কাজের মাত্রা অনুসারে প্রতিটি মানুষ তার ফল পাবে। যদি ব্যক্তিগত আত্মা অমর না হয় ডুবে পরকালের শাস্তি ও অশান্তির ধারণা অর্থহীন হয়ে পড়ে।
আত্মার অমরত্বে আল-ফারাবি বিশ্বাস করতেন কি না এ প্রসঙ্গে রবার্ট হামুন্ড পাঠকদের সংশয়ের আবর্তে ফেলেছেন। তাঁর মতে, আল-ফারাবি আত্মার ব্যক্তিগত অমরত্বে বিশ্বাস করতেন কি না এ বিষয়টি সন্দেহজনক। এ সন্দেহের সমর্থনে তিনি নিম্নোক্ত দু’টি যুক্তির অবতারণা করেছেন:
প্রথমত: ফারাবির ‘য়ওনুল মাসায়েল’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন যে, দেহের অবসানের পর শুধু চালক বুদ্ধি
অবশিষ্ট থাকে, যা ধ্বংসশীল নয়। চালক বুদ্ধির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল-ফারাবি এ উক্তি করেছেন, আত্মার অমরত্ব প্রসঙ্গে নয়। কারণ উক্ত গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন যে, মৃত্যুর পর মানুষের আত্মার কল্যাণ হতে পারে আবার অকল্যাণও হতে পারে।
দ্বিতীয়ত: রবার্ট হামুন্ড যুক্তির সমর্থনে বলেন যে, ফারাবি এরিস্টটলের নিকোমেকিয়ান ইথিকস এর একটি ভাষ্য রচনা করেছিলেন। ইবনে রুশদ এ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন যে, মানবজীবনের পরম কল্যাণ ইহকালেই নিহিত। পরকালের কল্যাণ কামনা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। রবার্ট হামুন্ডের এ উক্তিটির সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন।
মূল্যায়ন: আল-ফারাবি মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম। আল-ফারাবি বিশ্বব্যাপী কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন। মানুষের আত্মিক উন্নতির সহায়ক হল কল্যাণকামী রাষ্ট্র। আল-ফারাবি আত্মার অমরত্বে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করতেন কি না এ প্রসঙ্গে রবার্ট হামুন্ড পাঠকদের সংশয়ের আবর্তে ফেলেছেন। মূলত আল-ফারাবি এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মা সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। মৃত্যুর পর আত্মার অবস্থান সম্পর্কে বর্ণনা প্রসঙ্গে ফারাবি বলেছেন যে, মানুষের মৃত্যুর পর তাদের আত্মা এক এক করে একত্রিত হতে থাকবে।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, আল-ফারাবি আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছেন। পবিত্র কুরআনের সুরে সুর মিলিয়ে তিনি আত্মা সম্পর্কে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে খুবই অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন মানবদরদি ও কল্যাণকামী। আর এ কারণেই তিনি মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য সংঘবদ্ধভাবে প্রচেষ্টার উপর জোর দিয়েছেন ও বিশ্বব্যাপী কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেছেন।