দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে দার্শনিকদের যুক্তিগুলো গাজালি কিভাবে খণ্ডন করেন? ব্যাখ্যা কর।

অথবা, দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কিত দার্শনিকদের মতের সাথে গাজালির মতের পার্থক্য নির্দেশ কর।

অথবা, দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে দার্শনিকদের যুক্তিগুলো গাজালি কিভাবে খণ্ডন করেন আলোচনা কর।

অথবা, দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কিত দার্শনিকদের মতের সাথ গাজালির মতের পার্থক্য বিশ্লেষণ কর।

অথবা, দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কিত দার্শনিকদের মতের সাথে গাজালির মতের বৈসাদৃশ্য বর্ণনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: ইমাম আল গাজালি ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা ও রক্ষক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি যুক্তির দ্বারা, মেধা ও লেখনী দ্বারা এবং শক্তির দ্বারা মুসলিম সমাজকে জাগ্রত করতে প্রয়াসী ছিলেন। তিনি কেবল সবাইকে উপদেশই দেন নি, বরং নিজ জীবনে তা পালন করে দেখিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ইমামী শক্তিতে শক্তিমান একজন সুফি সাধক। অন্যদিকে দার্শনিক হিসেবে ছিলেন অসাধারণ যুক্তিবাদী ও সংশয়বাদী। সুতরাং মুসলিম দর্শনে গাজালিকে কখনো অস্বীকার করা যায় না।

আল গাজালির পরিচয়: আল গাজালি ১০৫৮ সালে ইরানের খোরাসান নামক প্রদেশের অন্তর্গত তুস নগরীতে জনন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম আবু হামিদ মোহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে তাইস আহমন আল কুলী আল শাখী আল নিশাপুরী। অনেকে মনে করেন, তার জন্ম পল্লি গাজ্জাল এর নামানুসারেই তিনি গাজালি উপাধি ধারণ করেন। আবার কোন কোন গবেষক মনে করেন, গাজালি তার বংশগত উপাধি। তাঁর পারিবারিক ব্যবসায় ছিল পশমের। বংশানুক্রমিক পেশায় কারণে তাকে গাজালি বলা হয় বলে অনেকের ধারণা। ৪৩ বছর বয়সে তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের ধর্মতত্ত্ব বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। তিনি ৪০০ টির বেশি গ্রন্থ লিখে গেছেন, যার মধ্যে ৭০টির মতো গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। ‘কিমিয়ায়ে সাদাত’, ‘ইয়াহ্ ইয়া-উল-উলুম-আদদীন’, ‘তাহফুতুল ফালাসিফা’, ‘আল-মুনকিদ মিল-আল’ প্রভৃতি তার বিখ্যাত গ্রন্থ।

দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে দার্শনিকদের যুক্তি: দার্শনিকরা পারলৌকিক জীবনে কেবল আত্মিক অনুভব বা জ্ঞানগত অনুভবের কথা স্বীকার করেন। কুরআনে বর্ণিত পারলৌকিক বিষয়াবলি তারা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করে রূপক অর্থে গ্রহণ করেন। কিন্তু আল গজালি একে আকারগতভাবে বিশ্বাস করেন যার মূলকথা হলো তিনি দৈহিক পুনরুত্থানে বিশ্বাস করেন। তাঁর মতে, দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে যুক্তিসমূহ অসার। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো:

দার্শনিকদের প্রথম যুক্তি: দার্শনিকদের প্রথম যুক্তি ছিল দৈহিক পুনরুত্থানে তিনটি বিকল্প থাকতে পারে। সেগুলো হলো:

ক. দেহের মূল উপাদান মৃত্তিকা পুনরায় একত্রিত করে পুনরায় নতুনভাবে আকার দেয়া।

খ. আত্যা দেহের অংশগুলো একত্রিত করবে।

গ. যে কোন দেহেই তা পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।

দার্শনিকদের যুক্তি হলো এ তিন ধরনের কোন যুক্তিই গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা প্রথম বিকল্পটি দৃশ্যত অসম্ভব। তাছাড়া বিকল্প অনুসারে আত্মার পক্ষে দৈহিক অংশগুলো একত্রিত করা সম্ভবপর নয়। অন্যদিকে যে কোন দেহই যদি আত্যা গ্রহণ করে তাহলে পূর্বের ব্যক্তির আত্মা এবং পরবর্তীতে আত্মাধারী দেহটির মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে না।

প্রথম যুক্তির বিরুদ্ধে গাজালির প্রতিবাদ: দার্শনিকদের প্রথম যুক্তিটিকে ইমাম আল গাজালি ভ্রান্ত বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তাঁর মতে, এ যুক্তি দ্বারা দৈহিক পুনরুত্থানকে অস্বীকার করা যায় না। কেননা শরীয়তে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে যে, আল্লাহ মানুষকে দৈহিকভাবে পুনরুত্থান করবেন। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। যারা জগতের সৃষ্টিতেই বিশ্বাস করে না তারা দেহের ফাংনের পর পুনরায় আল্লাহ কর্তৃক দেহ সৃষ্টি করার কথা স্বীকার করতে পারে না। তাছাড়া দৈহিক পরিবর্তন মানুষের অভিন্নতা খর্ব করে না; কেননা শিশু হতে বার্ধক্য পর্যন্ত নানাবিধ পরিবর্তনের ফলেও মানুষের অভিন্নতা সংরক্ষিত হয়।

দার্শনিকদের দ্বিতীয় যুক্তি: দার্শনিকদের দ্বিতীয় যুক্তি হলো জগৎ সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে পরিচালিত হয়ে থাকে। মানব দেহ সৃষ্টির একটি পর্যায়ক্রম রয়েছে যেমন বীর্জ হতে শিশুরূপে ভূমিষ্ঠ হওয়া এবং পরিশেষে বার্ধ্যক্যে উপনীত হয়ে মৃত্যুবরণ করা। দার্শনিকরা আরো বলেছেন, যারা দৈহিক পুনরুত্থানে বিশ্বাসী তারা মূলত লোহাকে কোন পর্যায় ছাড়াই মাথার পাগড়ি বানাতে চান। মূলত লোহাকে সুতায় পরিণত না করা পর্যন্ত তার দ্বায়া পাগড়ি বানানো সম্ভব নয়। আর তাই পরকালে কুন বলার সাথে সাথে দৌহিক পুনরুত্থান সম্ভব নয়।

দ্বিতীয় যুক্তির বিরুদ্ধে গাজালির প্রতিযাদ: আল গাজালির মতে, দার্শনিকরা কুন শব্দের অর্থ বুঝতে সক্ষম হন নি। তাছাড়া যিনি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা তিনি দৃশ্যমান নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে সৃষ্টি করতে পারবেন না, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সৃষ্টির জন্য যদি নির্ধারিত পদ্ধতিই অত্যাবশ্যক হতো তাহলে কেন মানুষ সে নিয়মানুসারে কোন বস্তুকে সৃষ্টি করতে পারে না। তাই আল্লাহর সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় বাধ্যবাধকতা আরোপ সঙ্গত নয়। কেননা তার শক্তি যেমন অফুরন্ত তেমনি কর্মপদ্ধতিও বিচিত্র। তাই দৈহিক পুনরুত্থান অসম্ভব বলার অর্থ হবে আল্লাহর ক্ষমতাকে সীমিতকরণের প্রচেষ্টা।

দার্শনিকদের তৃতীয় যুক্তি: দার্শনিকরা এ যুক্তিতে বলেছেন, জগতের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, আল্লাহর কর্ম পদ্ধতির মধ্যে কোন পরিবর্তন নেই। তিনি যখন কোন নিয়ম চালু করেন তখন তা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। মানুষের দৈহিক গঠন সম্পর্কে তিনি যে নিয়ম প্রচলন করেন তা বহাল থাকাই শ্রেয়। আর এ দিক দিয়ে পরকালে যদি পুনরুত্থান সম্ভব হয় তাহলে তা নিয়মে পরিণত হবে এবং তা অনন্তকাল ধরে চলবে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাই দৈহিক পুনরুত্থান সম্ভব নয়।

তৃতীয় যুক্তির বিরুদ্ধে গাজালির প্রতিবাদ: আল্লাহ নিয়মকে সৃষ্টি করেন তা সৃষ্টজীবের সুবিধার্থে। তাই বলে তিনি
নিজে সে নিয়মের অধীন নন। তিনি সাধারণত একই নিয়মে সাধারণত কাজ করেন তবে তিনি সে নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন। তিনি ইচ্ছা করলে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে পারেন। আমরা দেখি যে, মরিয়ম (আ) এর গর্ভে প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে ইসা (আ) জন্মগ্রহণ করেন। ফলে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটানো যে সম্ভব নয়; তা সঠিক নয়। তাই গাজালির মতে, দার্শনিকদের তৃতীয় যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া দার্শনিকদের তৃতীয় যুক্তিটি প্রথম ও দ্বিতীয় যুক্তির উপর নির্ভরশীল। তাই দার্শনিকদের কোন যুক্তিই গ্রহণযোগ্য নয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলিম মনীষীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ আল গাজালি সমকালীন চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে মুসলিম জাতিকে গ্রহণযোগ্য পথের নির্দেশ দিয়েছিলেন; যা ধর্মীয় ও পার্থিব জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি ইবনে রুশদের মতো শুধু আত্মিক পুনরুত্থানকে সমর্থন করেন নি। তিনি সাধারণ মুসলমানদের চিন্তা দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে যৌক্তিক অবস্থান নেন, যা ইসলামের বিশুদ্ধতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।