দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে আল-গাজালির মত ব্যাখ্যা ও বিচার কর।

অথবা, আল গাজালির দৈহিক পুনরুখান সম্পর্কিত মতবাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে আল গাজ্জালির মত আলোচনা কর।

অথবা, দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে আল গাজ্জালির মতবাদ বিস্তারিত বর্ণনা কর।

অথবা, দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে আল গাজালি বিরূপ মতবাদ দেন বিস্তারিত লেখ।

উত্তরঃ ভূমিকা: ইমাম আল গাজালি ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা ও রক্ষক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি যুক্তিনা দ্বারা, মেধা ও লেখনী দ্বারা এবং শক্তির দ্বারা মুসলিম সমাজকে জাগ্রত করতে প্রয়াসী ছিলেন। তিনি কেবল সবাইকে উপদেশই দেন নি, বরং নিজ জীবনে তা পালন করে দেখিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ইমামী শক্তিতে শক্তিমান একজন সুফি সাধক। অন্যদিকে দার্শনিক হিসেবে ছিলেন অসাধারণ যুক্তিবাদী ও সংশয়বাদী। সুতরাং মুসলিম দর্শনে গাজালিকে কখনো অস্বীকার করা যায় না।

দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে দার্শনিকদের যুক্তি: দার্শনিকরা পারলৌকিক জীবনে কেবল আত্মিক অনুভব বা জ্ঞানগত অনুভবের কথা স্বীকার করেন। কুরআনে বর্ণিত পারলৌকিক বিষয়াবলি তারা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করে রুপক অর্থে গ্রহণ করেন। কিন্তু আল গজালি একে আকারগতভাবে বিশ্বাস করেন যার মূলকথা হলো তিনি দৈহিক পুনরুত্থানে বিশ্বাস করেন। তাঁর মতে, দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে যুক্তিসমূহ অসার। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো:

দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে আল-গাজালীর মত : দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে আল-গাজালীর প্রথমে সমসাময়িক দার্শনিকদের যুক্তিগুলো খণ্ডন করেন এবং নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেন। প্রশ্নপত্রের আলোকে এ সম্পর্কে নিয়ে আলোচনা করা হলো:

আল্লাহ মানুষকে পুনরুত্থান করবেন: দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে দার্শনিকদের প্রথম যুক্তি হলো- দেহের মূল উপাদান মৃত্তিকা পুনরায় একত্রিত করে পুনরায় নতুনভাবে আকার দেয়া যায়। তাই দৈহিক পুনরুত্থান সম্ভব নয়।

ইমাম আল গাজালি দার্শনিকদের এই প্রথম যুক্তিটিকে ভ্রান্ত বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তাঁর মতে, এ যুক্তি যারা দৈহিক পুনরুত্থানকে অস্বীকার করা যায় না। কেননা শরীয়তে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে যে, আল্লাহ মানুষকে দৈহিকভাবে পুনরুত্থান করবেন। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। যারা জগতের সৃষ্টিতেই বিশ্বাস করে না তারা দেহের মাংসের পর পুনরায় আল্লাহ কর্তৃক দেহ সৃষ্টি করার কথা স্বীকার করতে পারে না। তাছাড়া দৈহিক পরিবর্তন মানুষের অভিন্নতা খর্ব করে না; কেননা শিশু হতে বার্ধক্য পর্যন্ত নানাবিধ পরিবর্তনের ফলেও মানুষের অভিন্নতা সংরক্ষিত হয়। কাজেই গাজালীর মতে মানুষের দৈহিক পুনরুত্থান অবশ্যই হবে।

আল্লাহর অসীম ক্ষমতাই দৈহিক পুনরুত্থানের প্রমাণ: দার্শনিকদের দ্বিতীয় যুক্তি হলো জগৎ সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে পরিচালিত হয়ে থাকে। মানব দেহ সৃষ্টির একটি পর্যায়ক্রম রয়েছে যেমন বীর্জ হতে শিশুরূপে ভূমিষ্ঠ হওয়া এবং পরিশেষে বার্ধক্যে উপনীত হয়ে মৃত্যুবরণ করা। দার্শনিকরা আরো বলেছেন, যারা দৈহিক পুনরুত্থানে বিশ্বাসী তারা মূলত লোহাকে কোন পর্যায় ছাড়াই মাথার পাগড়ি বানাতে চান। মূলত লোহাকে সুতায় পরিণত না করা পর্যন্ত তার দ্বায়া পাগড়ি বানানো সম্ভব নয়। আর তাই পরকালে কুন বলার সাথে সাথে দৌহিক পুনরুত্থান সম্ভব নয়।
আল গাজালি দার্শনিকদের দ্বিতীয় যুক্তি খণ্ডন করে বলেন, দার্শনিকরা কুন শব্দের অর্থ বুঝতে সক্ষম হন নি। তাছাড়া যিনি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা তিনি দৃশ্যমান নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে সৃষ্টি করতে পারবেন না, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সৃষ্টির জন্য যদি নির্ধারিত পদ্ধতিই অত্যাবশ্যক হতো তাহলে কেন মানুষ সে নিয়মানুসারে কোন বস্তুকে সৃষ্টি করতে পারে না। তাই আল্লাহর সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় বাধ্যবাধকতা আরোপ সঙ্গত নয়। কেননা তার শক্তি যেমন অফুরন্ত তেমনি কর্মপদ্ধতিও বিচিত্র। তাই দৈহিক পুনরুত্থান অসম্ভব বলার অর্থ হবে আল্লাহর ক্ষমতাকে সীমিতকরণের প্রচেষ্টা। কাজেই আল গাজালি সুস্পষ্টভাবে বলেন যে মানুষের দৈহিক পুনরুত্থান সম্ভব।

আল্লাহর ব্যতিক্রমী নিয়মেও দৈহিক পুনরুত্থান সম্ভব: প্রচলিত দার্শনিকরা বলেন যে, জগতের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, আল্লাহর কর্ম পদ্ধতির মধ্যে কোন পরিবর্তন নেই। তিনি যখন কোন নিয়ম চালু করেন তখন তা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। মানুষের দৈহিক গঠন সম্পর্কে তিনি যে নিয়ম প্রচলন করেন তা বহাল থাকাই শ্রেয়। আর এ দিক দিয়ে পরকালে যদি পুনরুত্থান সম্ভব হয় তাহলে তা নিয়মে পরিণত হবে এবং তা অনন্তকাল ধরে চলবে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাই দৈহিক পুনরুত্থান সম্ভব নয়।

আল-গাজালী দার্শনিকদের এ যুক্তি খণ্ডন করে বলেন যে, আল্লাহ নিয়মকে সৃষ্টি করেন তা সৃষ্ট জীবের সুবিধার্থে। তাই বলে তিনি নিজে সে নিয়মের অধীন নন। তিনি সাধারণত একই নিয়মে সাধারণত কাজ করেন তবে তিনি সে নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন। তিনি ইচ্ছা করলে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে পারেন। আমরা দেখি যে, মরিয়ম (আ) এর গর্ভে প্রচলিত। পদ্ধতির বাইরে ইসা (আ) জন্মগ্রহণ করেন। ফলে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটানো যে সম্ভব নয়; তা সঠিক নয়। তাই গাজালির মতে, আল্লাহ ব্যতিক্রমী নিয়মেও মানুষের দৈহিক পুনরুত্থানের কথা প্রমাণিত হয়।

মূল্যায়ন: আল-গাজালী দার্শনিকদের যুক্তিগুলো খণ্ডন করে দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে যেসব অভিমত ব্যক্ত করেন সেগুলো পিছনে যথেষ্ট ধর্মীয় প্রমাণ রয়েছে। তিনি কুরআন, হাদিস, শরীয়ত এবং জাগতিক বিভিন্ন প্রমাণ দ্বারা মানুষের দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাই দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে আল-গাজালীর ব্যাখ্যা মুসলিম দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলিম মনীষীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ আল গাজালি সমকালীন চিন্ত ধোরাকে মুসলিম জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য করে সঠিক পথের নির্দেশ দিয়েছিলেন; যা ধর্মীয় ও পার্থিব জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি ইবনে রুশদের মতো শুধু আত্যিক পুনরুত্থানকে সমর্থন করেন নি। দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে তিনি সাধারণ মুসলমানদের চিন্তাকে যৌক্তিক অবস্থানে নিয়ে যান, যা ইসলামের বিশুদ্ধতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।