অথবা, দ্বৈতশাসন, সম্পর্কে কী জান? কিভাবে এর পতন হয়?
অথবা, দ্বৈতশাসন উল্লেখপূর্বক দ্বৈতশাসনের শেষ পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের ইতিহাসে লর্ড ক্লাইভের দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পলাশি যুদ্ধের পর থেকে বাংলার শাসনব্যবস্থায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৬৫ সালের দেওয়ানি লাভের মধ্য দিয়ে তাদের সেই প্রভাব অপ্রতিহত হয়ে উঠার সুযোগ পায়। কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানী অর্থাৎ রাজস্ব শাসনের অধিকার লাভ করার ফলে সম্রাটের প্রতিনিধিরূপে বাংলার সুবাদারের দেওয়ানি ও ফৌজদারি শাসন ক্ষমতা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় যা দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত।
দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা: কোম্পানির দেওয়ানি লাভের পর ক্লাইভ প্রবর্তিত ‘বাংলার শাসনব্যবস্থাকে দ্বৈত শাসন বলা হয়। দ্বৈত শাসনের অর্থ হলো দুই জনের শাসন। নিজামতি বা বাংলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ফৌজদারি বিচার, শান্তিরক্ষা, দৈনন্দিন প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব ছিল বাংলার নবাবের হাতে। আর বাংলার রাজস্ব আদায়, দেওয়ানি সংক্রান্ত বিচার, জমি-জায়গার বিবাদ সম্পর্কিত বিচার কোম্পানির উপর বর্তায়। বাংলার শাসনের দায়িত্ব দুইটি পৃথক সংস্থার হাতে চলে যাওয়াই হচ্ছে দ্বৈতশাসন।
দ্বৈতশাসনের অবসান: যে সকল কারণ ও ঘটনাপ্রবাহ দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসানকে ত্বরান্বিত করেছিল সেগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. কোম্পানির দায়িত্বহীন ক্ষমতা: দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ছিল নবাবের হাতে কিন্তু অর্থ ও সোনা ভিন্ন এই দায়িত্ব নিজামতের পক্ষে পালন করা সম্ভব ছিল না এবং এর জন্য তাকে কোম্পানির উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল করে রাখা হয়। শাসন সংক্রান্ত বিয়য়ে নবাবকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে কোম্পানি লাভ করে দায়িত্বহীন ক্ষমতা। এভাবে কোম্পানির দায়িত্বহীন ক্ষমতার ফলে কোম্পানির রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি হলেও প্রশাসনিক জটিলতা বৃদ্ধি পায় যা দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসানকে ত্বরান্বিত করে।
২. কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা ও অত্যাচার: ক্লাইভের প্রবর্তিত দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়ে। দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা চরম পর্যায়ে নেমে আসে। এ সম্পর্কে রেজা খান কলকাতার সিলেক্ট কমিটিকে জানান যে, কোম্পানির কর্মচারী ও গোমস্তারা বিভিন্ন নিজ প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপর একচেটিয়া ব্যবসা স্থাপন করেছে, তারা জোরপূর্বক স্বল্পমূল্যে দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করে অধিকমূল্যে বিক্রয় করে, রায়তদের তারা নানাবিধ দ্রব্যাদি সরবরাহ করতে বাধ্য করে, প্রথানুসারে শুল্ক দিতে অস্বীকার করে, দেশীয় ব্যবসায়ীদেরকে উৎপীড়ন করে।
৩. রাজস্বনীতি সম্পর্কে অজ্ঞতা: বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব কোম্পানির উপর অর্পিত হওয়ায় রাতারাতি কোম্পানির ফ্যাক্টর ও বণিকরা প্রশাসকে পরিণত হলো। এসব নতুন প্রশাসকদের দেশীয় রাজস্ব নীতি সম্পর্কে কোনো ধ্যান-ধারণা ছিল না বললেই চলে। তারা ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধ্যান-ধারণা এদেশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল; যার অবসান ঘটাতে য়া কোম্পানির কর্তৃপক্ষ দ্বৈতশাসন রহিত করতে হয়েছিল।
৪. কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানির দায়িত্ব গ্রহণ : কার্যভার গ্রহণ করেই বোর্ডের নির্দেশক্রমে হেস্টিংস ১৭৭২ সালের এপ্রিল মাসে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে দেওয়ানি পরিচালনার ভার কোম্পানির হস্তে ন্যস্ত করলো। এযাবৎ কোম্পানি দেওয়ানি লাভের সুযোগ-সুবিধা সবই ভোগ কবে আসছিল বটে, কিন্তু দেওয়ানি সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব ছিল নবাবের উপর। কিন্তু ১৭৭২ সালে হেস্টিংস সরাসরি কোম্পানির পক্ষে দেওয়ানির যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
৫. রাজস্বের হার বৃদ্ধি: পলাশির পর থেকে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে কোম্পানির হস্তক্ষেপের ফলে দেশের সম্পদ হ্রাস পেতে থাকে। কিন্তু রাজস্বের হার প্রতিবছর বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেমনঃ ১৭৬৯ সালে রেজা খান অভিযোগ করেন যে, আলীবর্দী খানের আশল পূর্নিয়া জেলার বাৎসরিক রাজস্ব যেখানে মাত্র ৪ লক্ষ টাকা ছিল সেখানে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৬৯ সালে ২৫ লক্ষ টাকায় উন্নীত হয়। আবার দিনাজপুর জেলার ১২ লক্ষ টাকা হতে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭ লক্ষ টাকায় উন্নীত হয়। এভাবে প্রত্যেক বছর রাজস্বের হার বৃদ্ধির ফলে রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষেত্রে চরম অসুবিধার সৃষ্টি হয়।
৬. রাজস্ব আদায়ে কঠোরতা: পলাশি যুদ্ধের পর থেকে দেশের সম্পদ হ্রাস পেতে থাকে, কিন্তু রাজস্বের হার প্রতি বছরই বড়তে থাকে। প্রত্যেক জেলায় রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব রেজা খানের উপর অর্পিত হয়। তিনি এই অতিরিক্ত রাজস্ব সংগ্রহের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে প্রজাদের অসীম দুঃখ-দুর্দশা পোহাতে হয়। কোম্পানির জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মচারী বিলেতের কর্তৃপক্ষের কাছে মন্তব্য করেছিলেন, “কোম্পানির দেওয়ানি লাভের ফলে প্রজাদের যে দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছে, আগে তেমন কখনো হয়নি। আগের অনেক স্বেচ্ছাচারী নবাবের : আমলেও দেশের যে অতুল সম্পদ ছিল এখন তা ধ্বংসের 1 সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে।”
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, দ্বৈতশাসন ছিল লর্ড ক্লাইভজ প্রবর্তিত একটি কুশাসন ব্যবস্থা। এর জাঁতাকলে পড়ে যখন বাংলার – জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থা চরমে উঠে এবং কোম্পানির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দেয়, তখন কোম্পানির ডাইরেক্টর সভার নির্দেশ অনুসারে নবনিযুক্ত গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ সালে দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটান। এর ফলে কোম্পানির শাসন ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়।