অথবা, দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা জনসাধারণের উপর কেমন মনোভাব দেখা যায়?
অথবা, দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা জনসাধারণের উপর কেমন পরিলক্ষিত হয়েছিল?
উত্তর: ভূমিকা: রবার্ট ক্লাইভের দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা জনসাধারণের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এ ব্যবস্থায় নবাব ও কোম্পানির উপর স্ব-স্ব দায়িত্ব অর্পিত হলেও প্রকৃতপক্ষে কারও কোনো ক্ষমতা ছিল না। এটি জনসাধারণের জন্য ছিল এক অভিশাপস্বরূপ। এটি বাংলায় শাসন ব্যবস্থায় এক চরম অরাজকতার সৃষ্টি হয় এবং জনগণের দুঃখ-দুর্দশা চরমে পৌছে।
জনসাধারণের উপর প্রভাব: নিম্নে দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার ফলে বাংলার জনসাধারণের উপর কি প্রভাব ফেলেছিল সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. বাংলার অবণতি: দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার ফলে বাংলার যে সর্বাঙ্গীণ অবনতি ঘটেছিল তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে বাংলার অর্থনীতি যে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয় রেজা খানের বক্তব্যতেই তা স্পষ্ট হয়। রাজস্ব বকেয়া এক অর্থনৈতিক অবনতির জন্য কোম্পানির কর্তৃপক্ষ রেজা খানকে দায়ী করলে তিনি এক পত্রে কোম্পানিকে জানান যে, এর জন্য দায়ী কোম্পানি, রেজা খান নয়।
২. প্রাইভেট ট্রেড: দ্বৈত শাসনের প্রভাবে বাংলার উৎপাদক শ্রেণির যে ক্ষতিসাধিত হয় তা বর্ণনাতীত। কোম্পানির কর্মচারীরা প্রাইভেট ট্রেড বা ব্যক্তিগত ব্যবসায় লিপ্ত ছিল। এর ফলে বাংলায় শস্য উৎপাদনকারীদের সর্বনাশ সাধিত হয়। সরিষা, বীজ, হলুদ, চাল প্রভৃতি উৎপন্নকারী কৃষকদের আগাম টাকা নিতে বাধ্য করে। তাদের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে ঐ সকল পণ্য খরিদ করত।
৩. রায়তদের দুর্দশা: এ ব্যবস্থার ফলে একদিকে শস্যপণ্য উৎপাদনকারীদের স্বল্পমূল্যে তা যেমন বিক্রয় করতে বাধ্য করা হত, অন্যদিকে আবার তাদের কাছ থেকে উচ্চ হারে রাজস্ব দাবি করত। এই দুই চাপে পড়ে রায়তদের নাভিশ্বাস উঠছিল।
৪. তাঁতিদের দুরবস্থা: এ ব্যবস্থার ফলে একদিকে রায়তদের দুর্দশা হয় বটে বরং তাঁতিদের অবস্থাও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। তাঁতিদের বলপূর্বক আগাম মূল্য নিতে বাধ্য করা হত। ফলে তাঁতিদের দুর্দশার সীমা ছিল না।
৫. ছিয়াত্তরের মন্বন্তর: দ্বৈতশাসনের কূফল যে কি মারাত্মক হতে পারে এর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। বাংলা ১১৭৬ এবং ইংরেজি ১৭৭০ সালে বাংলায় সংগঠিত মন্বন্তরের জনসংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি মৃত্যুমুখে পতিত হয়। বাংলার কৃষি ব্যবস্থা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা বিরল নয়। কিন্তু এর সাথে কোম্পানির কর্মচারীদের অত্যাচার ও জুলুম মিলিত হয়ে এক দুর্বিসহ অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। বাংলার মানুষের দুঃখ-কষ্ট শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। ১৭৭০ সালে অনাবৃষ্টির কারণে চালের মূল্য বৃদ্ধি পায়। ফলে বাংলায় এক চরম বিপর্যয় দেখা দেয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ক্লাইভ প্রবর্তিত দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা ছিল একটি অভিনব কৌশল। এ কৌশলে তাদের স্বার্থ ছিল যে, দেশীয় নৃপতিদের প্রতি জনসাধারণের মতের পরিবর্তন ঘটানো এবং কোম্পানির রাজস্ব আয়ের নিশ্চয়তা বিধান করা। কিন্তু এ ব্যবস্থা পরিবর্তনে ক্লাইভের যে উদ্দেশ্য ছিল বাস্তবে তার ফল দেখা যায় উল্টো কারণ এর ফলে কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। তাই পরে ১৭৬৯-৭০ সালে দুর্ভিক্ষ হয়।