অথবা, পরিকল্পনা বলতে কী বুঝ? পরিকল্পনা প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়গুলো বর্ণনা কর।
অথবা, পরিকল্পনা কী? পরিকল্পনার প্রভাব কীভাবে বিস্তার করে আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: একটি কার্য সম্পাদন ও একটি কার্য বাস্তবায়ন করার জন্য একটি মহলোকে পূর্ব থেকেই এর রূপরেখা নির্ধারণ করতে হয়। সঠিক রূপ রেখার কারণেই কার্য বাস্তবায়ন হয়। এ কার্য বাস্তবায় করার জন্য। প্রয়োজন পরিকল্পনা।
পরিকল্পনার সংজ্ঞা: সাধারণত পরিকল্পনা বলতে কোনো বিষয়ে কি করতে হবে, কখন করতে হবে, কিভাবে করতে হবে, কি দিয়ে করতে হবে প্রভৃতি রূপরেখাকে বুঝায়। ব্যাপক অর্থে বলা যায়, কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছার নিমিত্তে এর আওতাধীন সম্পদের সমবন্টনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের সুশৃঙ্খল পদক্ষেপ হচ্ছে পরিকল্পনার একটি কাজের অগ্রিম চিন্তা ও মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিজাত প্রক্রিয়া বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনাবিদ পরিকল্পনার বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা:
Robert L. Barker (1995: 284) এর সংজ্ঞানুযায়ী, “Planning is the process of specifying future objective, evaluating the means for achieving them and making deliberate choices about appropriate courses of action.”
(অর্থাৎ পরিকল্পনা হলো ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নির্ধারণ, সেগুলো অর্জনের বিভিন্ন পন্থার মূল্যায়ন এবং উপর্যুক্ত কার্যক্রমের সুচিন্তিত বাছাই প্রক্রিয়া।
আর্থার ডানহাম (Arthur Dunham) এর মতে, “Planning is fundamentally and intellectual process, a mental pre-disposition of to do work in an orderly way to think before act in the light of facts, rather than guesses.” অর্থাৎ পরিকল্পনা হচ্ছে মৌলিকভাবে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া, সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করা, কাজ করার পূর্বে চিন্তা করা, অনুমানের পরিবর্তে তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করার একটি মানসিক পূর্বাবস্থা।
Newman এর মতে, “Planning is decided in advance what is to be done, that is planning is a profected course of action.”-
H. B Trecker (1955) এর মতে, “Planning is the conscious and deliberate guidance of thinking so as to create logical means of achieving agreed upon goals.” অর্থাৎ পরিকল্পনা হচ্ছে সচেতন ও সুচিন্তিত নির্দেশনা মতে ঐক্যবদ্ধ উদ্দেশ্য অর্জনের যৌক্তিক ভিত্তি সৃষ্টি করা যায়।
Social work Dictionary (1995) এর সংজ্ঞানুযায়ী, “Planning is the process of specifying future objectives, evaluating the means for achieving them and making deliberate choices about appropriate courses of action.”
আলবার্ট ওয়াটারসন (Albert waterson) বলেন, “Planning is an organized, conscious and continual attempt to select the best alternatives to specific goals.” অর্থাৎ, পরিকল্পনা হলো বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্ভাবনা বিকল্পের সর্বোত্তম নির্বাচনের সচেতন ও ক্রমাগত প্রচেষ্টা।
বিভারস (Beavers) এর মতে, “Planning is the working out in broad outlines the thing that needed to be done and the methods for doing them.”
উল্লিখিত বিভিন্ন সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়, বহুসংখ্যক লক্ষ্যের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে যুক্তিপূর্ণ উপায়ে পৌছানোর সুচিন্তিত ও সচেতনভাবে কাজের বিবরণ নির্দেশ করাকে পরিকল্পনা বলে। এটি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে লক্ষ্য’ নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সম্পদের সদ্ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করা থাকে।
পরিকল্পনায় প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়সমূহঃ পরিকল্পনা প্রণয়নে কিছু কিছু বিষয়ের উপস্থিতি অত্যাবশ্যক। অনুকূল পরিবেশ ও সম্পদসহ কতিপয় বিষয় উত্তম পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রযোজ্য হয়। এসব বিষয়ের উপস্থিতি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো পরিকল্পনার বিবেচ্য বিষয় বা প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান হিসেবে বিবেচিত। নিম্নে পরিকল্পনায় প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়সমূহ বর্ণনা করা হলোঃ
১. সমস্যাঃ সমস্যাকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। সমস্যা বলতে এক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক সমস্যাকে বুঝায়। সমস্যা চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি এর সমাধানেরও নির্দেশনা থাকে পরিকল্পনায়। তাই সমস্যা ও সমস্যার সমাধান পরিকল্পনার অন্যতম বিবেচ্য বিষয়।
২. চাহিদা: পরিকল্পনায় প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো চাহিদা বা প্রয়োজন। কেননা পরিকল্পনা প্রণয়নকালে অবশ্যই অনুভূত চাহিদার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন অপরিহার্য চাহিদার সাথে পরিকল্পনা সম্পর্কিত।
৩. উপাত্তঃ পরিকল্পনা প্রণয়নে উপাত্ত বা তথ্য সরবরাহ ও তার বিশ্লেষণ করা অতি জরুরি। প্রয়োজনীয় তথ্যাবলির সহজলভ্যতা আবশ্যক। পরিকল্পনায় সমস্যা চিহ্নিতকরণ; লক্ষ্য স্থির করা, সম্পদ আহরণ সবকিছুই তথ্যসংগ্রহ ও বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করে।
৪. দক্ষতা ও নৈপুণ্য: পরিকল্পনা প্রণয়নে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের যথেষ্ট জ্ঞান, দক্ষতা ও নৈপুণ্যের অধিকারী হতে হয়। নতুবা পরিকল্পনা তৈরিতে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাই দক্ষতা ও নৈপুণ্য পরিকল্পনার অপরিহার্য বিষয়। তাই পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে দক্ষ হতে হবে।
৫. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: পরিকল্পনায় প্রণীত প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। কেননা লক্ষ্যবিহীন পরিকল্পনা মাঝিবিহীন নৌকার মতো। তাই প্রতিটি পরিকল্পনারই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা উচিত।
৬. দক্ষ কর্মী: পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিয়োজিত কর্মীদের দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে। দক্ষ কর্মীরা সুষ্ঠুভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে। তাই এটি পরিকল্পনার অন্যতম উপাদান।
৭. নীতিমালাঃ পরিকল্পনা মাত্রই কতিপয় নীতি থাকবে। নীতির উপর ভিত্তি করেই পরিকল্পনা প্রণীত হয়। পরিকল্পনাবিদরা নীতিসমূহকে অনুসরণ করে পরিকল্পনা প্রস্তুত করবে। তাই কতিপয় নীতিমালা এর বিবেচ্য বিষয়।
৮. সম্পদ: পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বস্তুগত ও অবস্তুগত অনেক সম্পদের প্রয়োজন হয়। তথ্য গবেষক তত্ত্বাবধান, ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন প্রভৃতি কাজে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। তাই অর্থসহ পরিকল্পনা প্রণয়নে সম্পদের গুরুত্ব অপরিহার্য।
৯. প্রক্রিয়া ও ধাপঃ পরিকল্পনা প্রণয়নে কিছু প্রক্রিয়া ও ধাপ অনুসরণ করা অত্যাবশ্যক। প্রক্রিয়া ও ধাপ অনুসরণের মাধ্যমে পরিকল্পনা সুশৃঙ্খল ও বিজ্ঞানসম্মত হয় এবং তা বাস্তবায়ন ও সহজ হয়। এজন্য প্রক্রিয়া ও ধাপ পরিকল্পনার অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়।
১০. সময়ঃ পরিকল্পনার কাজ শুরু করার সময় নির্দিষ্ট সময়ের কথা উল্লেখ থাকে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই পরিকল্পনার কাজ শেষ করতে হয়। তবে পরিকল্পনা প্রণয়নে পর্যাপ্ত সময় থাকা অত্যাবশ্যক।
১১. পদ্ধতি: পরিকল্পনা প্রণয়নে নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও কৌশল অনুসরণ করা হয়। পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তেই পদ্ধতি বা কৌশলকে গুরুত্ব দেয়া হয়। তাই এটি তার অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়।
১২. অগ্রাধিকারঃ পরিকল্পনায় কোন বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে কাজটি আগে করা
জরুরি তা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করার জন্য পরিকল্পনার তাগিদ থাকে।
১৩. প্রশাসন : পরিকল্পনা প্রস্তুত হবে একটি দক্ষ প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে। কেননা সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থা পরিকল্পনার জন্য খুবই জরুরি। তাই প্রশাসন ব্যবস্থা পরিকল্পনার একটি অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হিসেবে স্বীকৃত।
১৪. নেতৃত্বঃ দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব সুষ্ঠু পরিকল্পনার জন্য অপরিহার্য। কেননা ঘনিষ্ঠ নেতৃত্ব ছাড়া পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। যোগ্য নেতার নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা হয় বাস্তব উপযোগী ও তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা যায়।
১৫. মানসিকতা : উত্তম পরিকল্পনা তৈরিতে পরিকল্পনাবিদদের মনমানসিকতা একটি অপরিহার্য বিষয়। তাদের ইতিবাচক মনোভাব পরিকল্পনা প্রণয়ন যেমন সহজ করে তোলে, তেমনি তাদের নেতিবাচক নানাভাব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, উপর্যুক্ত বিষয়সমূহ পরিকল্পনার উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এসব বিষয়ের উপস্থিতি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য যেমন সহজ হয়, আবার এসবের অনুপস্থিতি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কঠিন করে তোলে।