পরিকল্পনা বলতে কি বোঝায়? বাংলাদেশে পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সাংগঠনিক কাঠামোসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, পরিকল্পনা কাকে বলে? বাংলাদেশের পরিকল্পনা প্রণয়নে সাংগাঠনিক প্রক্রিয়ার সাংগঠনিক কাঠামোগুলো বর্ণনা কর।

অথবা, পরিকল্পনার সংজ্ঞা দাও। বাংলাদেশে পরিকল্পনা প্রণয়নের সাংগাঠনিক প্রক্রিয়া কাঠামো সম্পর্কে যা জান লিখ।

উত্তর: ভূমিকা: একটি কার্য সম্পাদন ও একটি কার্য বাস্তবায়ন করার জন্য একটি মহলোকে পূর্ব থেকেই এর রূপরেখা নির্ধারণ করতে হয়। সঠিক রূপরেখার কারণেই কার্য বাস্তবায়ন হয়। এ কার্য বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা।

পরিকল্পনার সংজ্ঞাঃ সাধারণত পরিকল্পনা বলতে কোনো বিষয়ে কি করতে হবে, কখন করতে হবে, কিভাবে করতে হবে, কি দিয়ে করতে হবে প্রভৃতি রূপরেখাকে বুঝায়। ব্যাপক অর্থে বলা যায়, কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার নিমিত্তে এর আওতাধীন সংম্পদের সমবন্টনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের সুশৃঙ্খল পদক্ষেপ হচ্ছে পরিকল্পনার একটি কাজের অগ্রিম চিন্তা ও মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিজাত প্রক্রিয়া। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনাবিদ পরিকল্পনার বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।

প্রমাণ্য সংজ্ঞা:

Robert L. Barker (1995: 284) এর সংজ্ঞানুযায়ী, “Planning is the process of specifying future objective, evaluating the means for achieving them and making deliberate choices about appropriate courses of action.” (অর্থাৎ পরিকল্পনা হলো ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নির্ধারণ, সেগুলো অর্জনের বিভিন্ন পন্থার মূল্যায়ন এবং উপযুক্ত কার্যক্রমের সুচিন্তিত বাছাই প্রক্রিয়া।

আর্থার ডানহাম (Arthur Dunham) এর মতে, “Planning is fundamentally and intellectual process, a mental pre-disposition of to do work in an orderly way to think before act in the light of facts, rather than guesses.” অর্থাৎ পরিকল্পনা হচ্ছে মৌলিকভাবে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া, সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করা, কাজ করার পূর্বে চিন্তা করা, অনুমানের পরিবর্তে তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করার একটি মানসিক পূর্বাবস্থা।

Newman এর মতে, “Planning is decided in advance what is to be done, that is planning is a profected course of action.”

H. B Trecker (1955) এর মতে, “Planning is the conscious and deliberate guidance of thinking so as to create logical means of achieving agreed upon goals.” অর্থাৎ পরিকল্পনা হচ্ছে সচেতন ও সুচিন্তিত নির্দেশনা মতে ঐক্যবদ্ধ উদ্দেশ্য অর্জনের যৌক্তিক ভিত্তি সৃষ্টি করা যায়।

Social work Dictionary (1995) এর সংজ্ঞানুযায়ী, “Planning is the process of specifying future objectives, evaluating the means for achieving them and making deliberate choices about appropriate courses of action.”

আলবার্ট ওয়াটারসন (Albert waterson) বলেন, “Planning is an organized, conscious and continual attempt to select the best alternatives to specific goals.” অর্থাৎ, পরিকল্পনা হলো বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্ভাবনা বিকল্পের সর্বোত্তম নির্বাচনের সচেতন ও ক্রমাগত প্রচেষ্টা।
বিভারস (Beavers) এর মতে, “Planning is the working out in broad outlines the thing that needed to be done and the methods for doing them.”

উল্লিখিত বিভিন্ন সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়, বহুসংখ্যক লক্ষ্যের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে যুক্তিপূর্ণ উপায়ে পৌছানোর সুচিন্তিত ও সচেতনভাবে কাজের বিবরণ নির্দেশ করাকে পরিকল্পনা বলে। এটি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে লক্ষ্য নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সম্পদের সদ্ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করা থাকে।

বাংলাদেশে পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সাংগঠনিক কাঠামোঃ বাংলাদেশে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্ত বায়নে পরিকল্পনার প্রতিটি ধাপই যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়। পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সাংগঠনিক দিক। দেশভেদে সাংগঠনিক কাঠামো, ভিন্নতর হতে পারে। প্রক্রিয়ার সাধারণ ধাপগুলো যেমন পরিকল্পনা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত, সাংগঠনিক কাঠামো গঠন, লক্ষ্য নির্ধারণ, উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ, বিকল্প কার্যধারা চিহ্নিতকরণ, অগ্রাধিকার বিকল্প বাছাই, বাস্তবায়ন, পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন প্রভৃতি স্তরগুলো বাংলাদেশে অনুসরণ করা হয়। এদেশের পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সাংগঠনিক কাঠামো ভিন্ন ধরনের।

বাংলাদেশে পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ

১. জাতীয় সংসদ : বাংলাদেশে বর্তমানে জাতীয় সংসদ এদেশের জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৯১ সালের পূর্ব পর্যন্ত এদেশে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত ও রাষ্ট্রপতি শাসিত কাঠামোর সরকার পরিকল্পনার চূড়ান্ত নির্দেশনা দান করতো। ১৯৯১ সাল থেকে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত জাতীয় সংসদের উপর পরিকল্পনা প্রণয়নের মূল দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়।

২. জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (NEC): জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ এদেশে পরিকল্পনা প্রণয়নের সর্বোচ্চ। সাংগঠনিক সংস্থা। দেশের সরকার প্রধানের নেতৃত্বে এটি গঠিত হয়। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা এ সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনা করে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ যেসব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নির্দেশনা দিয়ে থাকে সেগুলো হলো বার্ষিক পরিকল্পনা, দ্বি-বার্ষিক পরিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রভৃতি পরিকল্পনা বছরে একবার সরকার প্রধানের সভাপতিত্বে (NEC) এনইসির সভা অনুষ্ঠিত হয়।

৩. জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটি (ECNEC): এনইসি (NEC) নির্ধারিত নীতি বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ সাংগঠনিক সংস্থা। দেশের সরকার প্রধানের নেতৃত্বে এটি গঠিত হয়। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা এ সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনা করে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ যেসব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়ে থাকে। এনইসি (NEC) নির্ধারিত নীতি বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ পরিষদ হলো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের কার্যনির্বাহী (ECNEC) I NEC কর্তৃক প্রণীত পরিকল্পনা, নীতিমালা ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে CNEC বছরে একবার অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ECNEC এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব ও সেনাবাহিনী প্রধান ECNEC এর সভায় উপস্থিত থাকেন।

৪. পরিকল্পনা কমিশন: পরিকল্পনা কমিশন পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সার্বিক কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব পালন করেন। পরিকল্পনা কমিশন আবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করেন। পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং অর্থ বরাদ্দের দায়িত্ব পালন করে এই কমিশন। এটি ECNEC এর সচিবালয় হিসেবেও কাজ করে।

৫. বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (IMED): আই এম ইডি (IMED) বিভাগের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করেন। এটি বাস্তবায়নধর্মী, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের দায়িত্ব পালন করেন। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নে কোন প্রকল্পটি লক্ষ্যার্জনে সক্ষম হয়েছে এবং কোনটি বন্ধ করা উচিত। তা নির্ধারণ করেন আইএমইডি (IMED)।

৬. পরিসংখ্যান বিভাগ: পরিসংখ্যান বিভাগ পরিকল্পনা মন্ত্রণায়ের অধীনে একটি বিভাগ। আবার পরিসংখ্যান বিভাগের অধীনে হলো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। তথ্য সংগ্রহ বিশ্লেষণ ও পরিকল্পনা প্রণয়নে এ বিভাগ সহায়তা করে। তাই পরিকল্পনা প্রণয়নে উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান বিভাগ ভূমিকা পালন করে।

৭. গবেষণা প্রতিষ্ঠানঃ পরিকল্পনা প্রণয়নে যেসব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান সহায়তা করে থাকে। সেগুলো হলো: বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা একাডেমি (BIDS)। সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমি প্রভৃতি পরিকল্পনা কমিশনের সাথে এসব প্রতিষ্ঠানের পরোক্ষ সম্পর্ক রয়েছে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, পরিকল্পনা প্রণয়ন একটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় প্রণীত হয়। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সফলতার জন্য এর প্রণয়ন প্রক্রিয়ার ধাপ নীতি, লক্ষ্য, পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্য, কলা-কৌশল বিবেচ্য বিষয় সবকিছুই যথাযথভাবে সম্পন্ন করেত হয়। বাংলাদেশেও পরিকল্পনা প্রণয়নে এসব দিক গুরুত্বের সাথে দেখা প্রয়োজন।