পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থতার কারণগুলো কী কী?

অথবা, ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কী কী? আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, আচার, প্রথা, প্রভৃতি ক্ষেত্রে পার্থক্যের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৭ সালে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আচার, প্রথা, পোশাক প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তর ব্যবধান ছিল। ফলে দুই পাকিস্তানের মধ্যে উপযুক্ত পার্থক্য থাকার কারণে পাকিস্তানের স্বাধীনতার সুদীর্ঘ ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রণয়ন হয়।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সংবিধান প্রণয়নের পটভূমি: ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন অনুসারে পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ গঠিত হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন এর সভাপতি। তিনি মারা যাওয়ার পর তমিজউদ্দিন খান সভাপতি হন। ১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ কর্তৃক প্রথম গণপরিষদ বাতিল ঘোষণা হয়।

অবশেষে আদালতের হস্তক্ষেপের ফলে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক এক অর্ডিন্যান্সের দ্বারা ১৯৫৫ সালের ২৯ মে দ্বিতীয় গণ-পরিষদ গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৪০ এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৪০ জন মোট ৮০ জন সদস্য নিয়ে এ গণপরিষদ গঠিত হয়। ১৯৫৫ সালের ৭ জুলাই পশ্চিম পাকিস্তানের মারীতে দ্বিতীয় গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর পাকিস্তানের উভয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ঐতিহাসিক ‘মারী চুক্তি’ নামে পরিচিত। মারী চুক্তি অনুযায়ী ১৯৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশকে এক ইউনিটে পরিণত করে দ্বিতীয় গণপরিষদে একটি বিল পাস হয়। মারী চুক্তিতে সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হক স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও সংখ্যাসাম্য নীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যাহোক দীর্ঘ সময় শেষে এ চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি একটি সংবিধান গৃহীত হয়।

পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সমস্যাবলি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে দুই পাকিস্তানের মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্র ও একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে এক সাধারণ ঐকমত্য ছিল। কিন্তু দুই পাকিস্তানের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা, ইসলাম ধর্মের অবস্থান, নির্বাচন ব্যবস্থা, কর্তৃত্ববাদী আমলাতন্ত্র, প্রভৃতি সম্বন্ধে জটিলতা ছিল। এছাড়াও আরো কতিপয় সমস্যার কারণে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নে বিলম্ব হয়। নিচে সবিস্তারে আলোচনা করা হলো:

১. রাষ্ট্রীয় মূলনীতি: হিন্দু ও মুসলমান দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা লাভ হয়। পাকিস্তান আন্দোলনে ধর্ম ছিল একটি বিশেষ উপাদান। অপরদিকে, নেতৃবৃন্দ ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বা আদর্শ নির্ধারণ ইসলাম ও আলেম সম্প্রদায়ের অবস্থান বা ভূমিকা কী হবে এ নিয়ে দুই পাকিস্তানে টানাপড়েন দেখা দেয় ও সে সম্বন্ধে বিতর্ক উঠে।

২. রাষ্ট্র ও সরকারের বৈশিষ্ট্য: একটি দেশের সংবিধান প্রণয়ন একটি মৌলিক বিষয়। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র ও সরকারের বৈশিষ্ট্য যুক্তরাষ্ট্রীয় না এককেন্দ্রিক, সংসদীয় না রাষ্ট্রপতি শাসিত, এককক্ষ না দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা তা স্থিরীকরণ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।

৩. কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা কটন পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং পূর্ব বাংলা পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি মেনে না নেয়া হয় এবং মেনে নেয়ার পর কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের বিষয় নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়।

৪. নির্বাচন ব্যবস্থা: নির্বাচন ব্যবস্থা যুক্ত হবে না পৃথক পৃথক হবে এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। একপক্ষ মনে করে, হিন্দু ও মুসলমান পৃথক পৃথক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আরেক পক্ষ মনে করে পৃথক নির্বাচনের আবশ্যকতা নেই। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয়।

৫. আমলাতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র: পাকিস্তানের সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্র ছিল শক্তিশালী ও সংগঠিত। অপরদিকে রাজনৈতিক দলসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কাঠামো ছিল খুবই দুর্বল। এ রকম অবস্থায় একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থাধীনে কিভাবে আমলাতন্ত্রকে নিয়ে আসা যায় সেটিও এক বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছিল।

৬. রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন: পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ দীর্ঘ বিতর্কই শুধু অনুষ্ঠিত হয়নি; ভাষা আন্দোলনের দাবিতে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ শহিদ পর্যন্ত হয়েছে। সামগ্রিক সংবিধান প্রণয়নে রাষ্ট্রভাষা মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলে।

৭. সংখ্যালঘুদের অধিকার: পাকিস্তান রাষ্ট্রে শতকরা প্রায় ১৫ ভাগের মতো সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ছিল। রাষ্ট্রে এদের কী এবং কিভাবে অধিকার থাকবে সংবিধান প্রণেতারা এ নিয়ে দারুণ সমস্যার সম্মুখীন হয়। যার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান সংবিধান প্রণয়নে বিলম্ব হয়।

৮. সরকারের অস্থিতিশীলতা পাকিস্তানে ১৯৫১ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ৭টি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কোন কোন প্রাদেশিক সরকারও অনুরূপ অস্থিতিশীল ছিল। এমনকি ২৪ ঘন্টার ভিতরও সরকার পরিবর্তনের নজির রয়েছে। ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আবু হোসেন মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব ২৪ ঘণ্টাও হতে পারেনি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো দক্ষ ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদও কেন্দ্রে ১৩ মাস মাত্র ক্ষমতাসীন ছিলেন।

৯. আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য: শুরু থেকেই পাকিস্তানে সামরিক বেসামরিক আমলাচক্র ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত। গোলাম মোহাম্মদ, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান সকলেই সামরিক বেসামরিক আমলাচক্রের প্রতিনিধি। রাজনীতি ও গণতন্ত্র চর্চার প্রতি এরা ছিলেন বরাবরই উদাসীন।

১০. রাষ্ট্রপ্রধানের হস্তক্ষেপ: জিন্নাহর মৃত্যুর পর যিনিই গভর্নর জেনারেল বা রাষ্ট্রপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন প্রায় সবাই জিন্নাহর পথ অনুসরণ করে সরকারের উপর হস্তক্ষেপ করতে সচেষ্ট হয়েছেন, যা ছিল সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি বিরুদ্ধ।

১১. নির্বাচনের অনুপস্থিতি: প্রত্যেক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট মেয়াদে জাতীয় ও অন্যান্য নির্বাচন অনুষ্ঠান একান্ত আবশ্যকীয়। পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের পূর্বে কোন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুকূল ব্যাপার নয়; বরং তাতে অগণতান্ত্রিক শক্তিই পুষ্ট হয়।

১২. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানে ব্যর্থতা: ১৯৫৬ সালের সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসনের ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু গভর্নর জেনারেল অবৈধ হস্তক্ষেপ, প্রদেশের উপর কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারি প্রভৃতি কারণে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়ন হয়নি।

১৩. শাসন ও আইন বিভাগের সম্পর্ক: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় প্রধান নীতি হচ্ছে আইনের শাসন। এক্ষেত্রে আইন ও শাসন বিভাগ উভয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু যথার্থ রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কালচারের অনুপস্থিতির কারণে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মাঝে দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। অনেকক্ষেত্রে আইনসভার সম্মতি ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ সাংবিধানিক রীতির লঙ্ঘন। আবার আইনসভার আস্থা থাকা সত্ত্বেও কতিপয় মন্ত্রিসভা বাতিল করা হয়েছে।

১৪. রাজনৈতিক চেতনার অভাব: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতা জনগণের রাজনৈতিক চেতনার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু পাকিস্তান বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাঝে রাজনৈতিক চেতনার চরম অভাব পরিলক্ষিত হয়। একবিংশ শতাব্দীতেও পাকিস্তানে সামরিক শাসন এর উদাহরণ। পাকিস্তানি জনগণের রাজনৈতিক চেতনার অভাবকেই নির্দেশ করে। জনগণের রাজনৈতিক অসচেতনতা ও সতর্ক দৃষ্টির অভাবে স্বার্থান্বেষী মহল সংসদীয় ব্যবস্থা অকার্যকর করতে প্রয়াস পায়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৫৬ সালে প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর না হওয়ার পিছনে উক্ত কারণসমূহ দায়ী। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য, মতানৈক্য, দ্বন্দ্ববিরোধ, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, প্রশাসনের জরাজীর্ণ অবস্থা, প্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভার অনুপস্থিতি ইত্যাদি বিষয়গুলো ১৯৫৬ সালের সংসদীয় ব্যবস্থাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে।