পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টিতে বাঙালি নেতাদের মনোভাব ব্যক্ত কর।

অথবা, পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টিতে বাঙালি নেতাদের মনোভাব সম্পর্কে ধারণা দাও।

উত্তর: ভূমিকা: ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীনতা হারানোর পর থেকে ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাঙালিদের অবদান ছিল চিরস্মরণীয়। এ সময় বিভিন্ন রকম ছোট ছোট আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল সেগুলোর সবগুলোরই মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। পরবর্তীতে ভারতের দলীয় রাজনীতিতে যে সকল বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ কর্মপ্রয়াস চালান তাদেরও মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু মুসলিম নেতৃবৃন্দ তাদের চিন্তাধারাকে বাস্তবে রূপদিতে পারেননি। যায় ফলে শুধুমাত্র ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালি নেতাদের মনোভাব: ১৯৪৭সালে ভারত স্বাধীনতা আইনের মধ্যদিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু এতে বাংলার নেতৃবর্গ ভয়ংকরভাবে হতাশ হয়ে পড়েন। নিম্নে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টিতে বাঙালি নেতাদের মনোভাবসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. লাহোর প্রস্তাব সংশোধন চক্রান্তে হতাশা: ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবই মূলত ভারতবর্ষে মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ বা states প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করে। বাংলার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। কিন্তু ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিলে অন্যায় ও অবৈধভাবে এক ঘৃন্যতম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পরিবর্তে একটি রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। এবং এরই ভিত্তিতে শুধুমাত্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। যা শুধু বাঙালি নেতাদের হতাশাই উপহার দেয়।

২. বাঙালিদের অবমূল্যায়নে ক্ষোভ: ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্তির সময় নানাভাবে বাঙালি নেতাদের কে অবমূল্যায়ন করা হয়। যেমন আবুল কাশেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়াদীর মত বিশিষ্ট আইনজীবীদেরকে বাদ দিয়ে বাউন্ডারী কমিশনে বিহারের এক অখ্যাত আইনজীবীকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
মুহম্মদ আলী জিন্নাহও এ বিষয়ে তেমন কোন গুরুত্ব দেননি। এতে মুসলিম নেতৃবৃন্দ ক্ষোভে ফেটে পড়েন।

৩. বাংলার স্বার্থ নিয়ে প্রতিক্রিয়া: বাংলার নানা স্বার্থ নিয়েও বাঙালি নেতৃবৃন্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বাংলার দায়-সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা করার জন্য বেঙ্গল পার্টিশন কাউন্সিল গঠিত হয়। এতে নানা রকম সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু এখানে গৃহীত বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত পূর্ববঙ্গের স্বার্থের অনুকূলে হয়নি।

৪. অনেক বাঙালি নেতার ভারতে অবস্থান: ভারতবর্ষে বিভক্তির পর নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার না করতে পারায় অনেক বাঙালি নেতা ভারতে অবস্থান করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আবুল হাশিম ছিলেন এদের মধ্যে অন্যতম। এদের ভারতে অবস্থান নিয়ে দলীয় পর্যায়ে নতুনভাবে অন্তর্দ্বন্দ্বের শুরু হয়।

৫. পূর্ব বাংলায় প্রত্যাবর্তন: লাহোর প্রস্তাবকে সংশোধন করে অন্যায়ভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ৩ জুন পরিকল্পনায় কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ কর্তৃক অবাঙালি আইনজীবী নিয়োগসহ পার্টিশন কাউন্সিলে পূর্ব বাংলাকে হৃদয়হীনভাবে বঞ্চিত করায় মুসলিম নেতৃবৃন্দ সদ্য প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ পূর্ব বাংলায় ফিরে আসেন।

৬. রাজনীতিতে ইস্তফা: অন্যায়ভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে মুসলিম নেতারা পূর্ববাংলার স্বার্থের প্রতি উদাসীন ছিল। এতে করে বাঙালি নেতারা চরমভাবে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। এবং এই কারণে অনেক বাঙালি নেতা মুসলিমলীগ ত্যাগ করেন। আবার এ.কে. ফজলুল হকের মত অনেক প্রবীণ বাঙালি নেতা চিরতরে রাজনীতিতে ইস্তফা দেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৪৭ সালে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের লোকেরা খুশি হলেও বাঙালি নেতারা এতে চরম ভাবে হতাশ হয়ে পড়েন। অনেক বাঙালি রাজনীতিবিদ রাগে ক্ষোভে রাজনীতি ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে তারা আবার পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলনে লিপ্ত হয়। এবং নানা বাধা বিভক্তির মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ।