অথবা, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামো সম্বন্ধে আলোচনা কর।
অথবা, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা দাও।
উত্তরঃ ভূমিকা: চিন্তানায়কদের সুচিন্তিত অভিমত এবং চিন্তার ফলে জ্ঞানরাজ্যের দিগন্ত বিস্তৃত হয়েছে যুগে যুগে। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে যে মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেন এবং যার চিন্তাধারা সর্বকালের সম্পদ হিসেবে গরিগণিত হচ্ছে তিনি হচ্ছেন প্লেটো। প্লেটোর রাজনৈতিক চিন্তাধারার মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠন করা আর এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি তার সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘দি রিপাবলিক’ এ সুন্দরভাবে আলোকপাত করেছেন কিভাবে একটি পরিপূর্ণ আদর্শ রাষ্ট্র গঠন করা যায়।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামো: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামো তিন ভাগে বিভক্ত। যথা:
১. দার্শনিক রাজা বা শাসক শ্রেণি,
২. যোদ্ধা শ্রেণি এবং
৩. উৎপাদক শ্রেণি।
নিম্নে এগুলোর সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. দার্শনিক রাজা বা শাসক শ্রেণি: আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামোতে প্লেটো দার্শনিক শাসকদের স্থান দিয়েছেন সর্বোচ্চ। দার্শনিক রাজা বা শাসক হবেন সে ব্যক্তি, যার ন্যায়ধর্ম, সৌন্দর্য এবং মিথ্যাচার সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকবে এবং যার কোন প্রকার লোভলালসা ও ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকবে না। প্লেটোর মতে, “রাষ্ট্রের শাসনভার জনগণের হাতে ন্যস্ত হওয়া উচিত নয়। কারণ গণতন্ত্র হলো নিকৃষ্টতম সরকার।” প্লেটো বলেছেন, “দার্শনিক শাসকগণ বা রাজাগণ শাসনকার্য পরিচালনার সময় কতকগুলো মৌলিক নীতি মেনে চলবেন।” যথা:
প্রথমত, রাষ্ট্রের যাতে ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ যাতে নিজ আওতায় কাজ করে সেদিকে দৃষ্টি দিবেন।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের আয়তন যাতে খুব বেশি না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ রাষ্ট্রের আয়তন বেশি হলে রাষ্ট্রীয় ঐক্য রক্ষা করা কঠিন হবে।
চতুর্থত, শিক্ষাপদ্ধতির যাতে কোনরূপ পরিবর্তন না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিবেন। প্লেটোর মতে, “দার্শনিক শাসকগণ কোন আইনের দ্বারা আবদ্ধ নন।” কারণ তাঁরা সর্বজ্ঞানী। তিনি বলেছেন, যখন শাসক ন্যায়বান হবেন, তখন আইন নিষ্প্রয়োজন। আবার যখন শাসক হবেন দুর্নীতিপরায়ণ, তখনো আইন হবে নিরর্থক।
২. যোদ্ধা শ্রেণি: প্লেটো বলেছেন, শুধু রাজ্যের শাসনভার দার্শনিক রাজা বা শাসকদের হাতে ন্যস্ত হলেই চলবে না, আদর্শ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাও প্রয়োজন। প্রবণতা অর্থাৎ সাহসও রাষ্ট্রের মধ্যে থাকা উচিত। রাষ্ট্র যাতে বাইরের কোন শক্তি কর্তৃক আক্রান্ত না হয়, সেজন্য দেশের প্রতিরক্ষার ভার এক সুনিপুণ যোদ্ধার উপর ন্যস্ত হওয়া আবশ্যক। এদের স্থান ঠিক দার্শনিক রাজাদের পরেই। যারা সাহল ক্ষমতালিপু হবে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষাই তাদের লতা। ক্ষমতার প্রতি লোভ থাকলে সঠিকভাবে পাহারা দিতে বা রক্ষা করতে পারবে না। তারা শাসক শ্রেণির মত বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে বিচ্যুত থাকবে। তাদের একমাত্র কাজ হবে যুদ্ধ পরিচালনা করা বা দেশকে রক্ষা করা।
৩. উৎপাদক শ্রেণি: রাষ্ট্রের শাসক ও প্রতিরক্ষার সাথে সাথে রাষ্ট্রের প্রতিপালনও প্রয়োজন। দার্শনিক ও যোদ্ধা শ্রেণি রাষ্ট্রকে যথাক্রমে শাসন ও প্রতিরক্ষা করতে পারে, কিন্তু প্রতিপালন করতে পারে না। রাষ্ট্রকে চালানোর জন্য যথেই পরিমাণে উৎপাদিত দ্রব্য থাকা একান্ত প্রয়োজন। এ মানবাত্মার সর্বনিম্ন অংশের বৈশিষ্ট্য যেমন ক্ষুধা, তেমনি রাষ্ট্রের সর্বনিম্ন স্তরে ক্ষুধা প্রধান শ্রেণি বিদ্যমান থাকবে। রাজনৈতিক জীবনে তাদের কোন ভূমিকা থাকবে না। এ শ্রেণির লোকের কেবল মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটানোর দায়িত্বভার গ্রহণ করবে। এভাবে সুন্দর জীবনকে লক্ষ্য করেই Plato তাঁর The Republic’ গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামো বর্ণনা করেন। মূলত তৎকালীন গ্রিসের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে প্লেটো একটি সুন্দর জীবন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য: প্লেটো তাঁর রিপাবলিকের মধ্যে যে আদর্শ রাষ্ট্রের চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তার মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
১. শ্রেণি শাসন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র একটি শ্রেণিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। এ রাষ্ট্রের অধিবাসীরা প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে
বিভক্ত। আপাতদৃষ্টিতে এ শ্রেণিবিন্যাসকে বর্ণ ব্যবস্থার ন্যায় মনে হলেও আসলে তা নয়। Prof. Sabine এর মতে, “এ শ্রেণিবিভাগকে বর্ণবিভাগ মনে করার কোন কারণ নেই। কারণ এখানে বংশের ভিত্তিতে কারও স্থান নির্ণয় করা হয় নি, বরং তিনি যে আদর্শ সমাজের কল্পনা করেছেন সেখানে প্রত্যেকটি শিশুকে তার স্বাভাবিক ক্ষমতা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রদান করা হবে এবং তার উপযুক্ততা (অর্থাৎ তার ক্ষমতা, শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা) অনুযায়ী রাষ্ট্রের মধ্যে তাকে সর্বোচ্চ স্থান অধিকারের সুযোগ দেয়া হবে। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্লেটোকে উল্লেখযোগ্যভাবে শ্রেণি পক্ষপাত হতে মুক্ত দেখা যায়।”
২. শ্রমবিভাগ ও বিশেষীকরণের সীতি: প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রকে শ্রমবিভাগ ও বিশেষীকরণের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
৩. দার্শনিক রাজার শাসন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা একমাত্র দার্শনিকদের হাতে ন্যস্ত থাকবে। অর্থাৎ দার্শনিক রাজাই হবেন শাসনক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। কারণ একমাত্র দার্শনিকরাই হচ্ছে যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী।
৪. ব্যক্তিগত সম্পতি বর্জন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে শাসক শ্রেণির জন্য কোনরূপ ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকতে পারে না। শাসক শ্রেণির ব্যয়ভার বহন করবে সরকার।
৫. বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ: শাসক শ্রেণির কোনরূপ স্থায়ী বৈবাহিক সম্পর্ক থাকবে না। সমাজে নিয়ন্ত্রিত জন্মদান পদ্ধতি প্রবর্তিত হবে।
৬. সাম্যবাদ: প্লেটোর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে তিনি উৎপাদক শ্রেণিকে সাম্যবাদ থেকে
মুক্ত রাখেন।
৭. বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা: প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রিত এক বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
৮. পারস্পরিক বন্ধন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের প্রতিটি অংশ পরস্পরের সাথে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িত। মূলত প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ছিল অবিমিশ্র অভিজাত তন্ত্র।
৯. ব্যক্তিভিত্তিক শাসন: আদর্শ রাষ্ট্রে আইনের কোন প্রয়োজন নেই। এ রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা ব্যক্তিভিত্তিক, আইনভিত্তিক নয়।
১০. ন্যায়বিচার: প্লেটো বলেছেন, “একমাত্র আদর্শ রাষ্ট্রে সর্বোত্তম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত।”
১১. গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের স্থান ছিল না। কারণ তিনি একে (গণতন্ত্রকে) মূর্খের শাসন মনে করতেন।
সমালোচনা: নিয়ে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সমালোচনা আলোচনা করা হলো:
১. উৎপাদক শ্রেণিকে অবহেলা: প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনায় উৎপাদক শ্রেণিকে চরমভাবে অবহেলা করেছেন। তাদের সামাজিক মর্যাদা না দিয়ে শুধু ভোগ্যবস্তু উৎপাদনের হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করেছেন, যা গণতন্ত্রবিরোধী।
২. মানবপ্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ: প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনায় অভিভাবক শ্রেণির জন্য পরিকল্পিত সাম্যবাদের ব্যবস্থা করে মানব প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। কারণ মানুষ তার ইচ্ছা সত্ত্বেও পারিবারিক জীবন উপলব্ধি করতে পারছে না।
৩. অবাস্তব কল্পনা: প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের শাসনভার দার্শনিক রাজার হস্তে অর্পণ করে স্বর্গরাজ্যের সন্ধানে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, যা সম্পূর্ণভাবে গণতন্ত্রবিরোধী ও অবাস্তব কল্পনা।
৪. নিম্নশ্রেণিকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত: আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য প্লেটো যে শিক্ষাব্যবস্থার কল্পনা করেছেন, তাতে নিম্নশ্রেণির শিক্ষার কোন সুযোগ নেই, যার কারণে একে গণতন্ত্রবিরোধী শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
৫. অরাজক শাসনব্যবস্থা: প্লেটো গণতন্ত্রকে অরাজক শাসনব্যবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা গণতন্ত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। প্লেটোর মতে, “এ হচ্ছে অদ্ভুত রকমের এক অরাজক ব্যবস্থা, যেখানে সমান ও অসমান সকলেই সমান।”
৬. গণতন্ত্র নিকৃষ্ট ধরনের শাসনব্যবস্থা: প্লেটো গণতন্ত্রকে নিকৃষ্টতর শাসনব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ এখানে যোগ্যতার কোন মূল্য নেই। গণতন্ত্রে ধনীগরিব সকলেই সমান। সুতরাং এ শাসনব্যবস্থায় ভালো কিছু আশা করা যায় না।
৭. ব্যক্তিত্ব খর্ব: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের মূলনীতি হচ্ছে, “রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি, ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়।” এ থেকে বুঝা যায়
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব খর্ব করা হয়েছে।
৮. নীতিহীন শাসনব্যবস্থা: প্লেটো বলেছেন, “গণতন্ত্র নীতিহীনতার শাসন। অন্যান্য শাসন-বিকৃত হলেও একটা নীতি থাকে কিন্তু গণতন্ত্রে কোন নীতির বালাই নেই।”
৯. স্বৈরতন্ত্রের দিশারি: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে দার্শনিক রাজা। তিনি অভিভাবকদের দিয়ে রাষ্ট্রের শাসনকার্য সম্পাদন করবেন। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর স্বাধানতা অর্পণ করা হয়েছে। এরূপ শাসন স্বৈরতন্ত্রের দিশারি ছাড়া আর কিছু নয়।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের মতবাদ গণতন্ত্র বিরোধী ও কাল্পনিক হলেও এটি অন্যায়, অবিচার ও কুশাসনের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। কেননা তৎকালীন গ্রিসের অরাজনৈতিকতা, বিশৃঙ্খলা এবং অবিচারের কথা চিন্তা করেই মূলত প্লেটো এ ধারণা ব্যক্ত করেন। তাঁর এ ধারণা বর্তমান কালের রাষ্ট্রচিও ায়ও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে আছে। তাঁর এ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী কালে বহু রাষ্ট্র দার্শনিক বহু মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। পরিশেষে বলা যায়, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা একটি কাল্পনিক ও অগণতন্ত্রী ধারণা কিন্তু এর অবদান যথেষ্ট।