অথবা, প্লেটোর দার্শনিক চিন্তার প্রকৃতি বর্ণনা কর।
অথবা, প্লেটোর রাষ্ট্রটিন্ডার ধরন উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: বিশ্ব রাষ্ট্র ব্যবস্থার অগ্রগতিতে ও সমাজসভ্যতার উন্নয়নে যেসব মনীষীর অবদান বা চিন্তাধারা বর্তমান সমাজেও দৃষ্টাডস্বরূপ হয়ে আছে, গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। গ্রিস রাষ্ট্রের অস্থিতিশীলতা, দেশের যুদ্ধাবস্থা প্রভৃতির অবসানকল্পে প্লেটো তাঁর বিখ্যাত The Republic’ গ্রন্থে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দেন। প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁরই শুরু মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মূলনীতি ‘Virtue is knowledge’ এবং ‘যা আদর্শ তাই বাস্তব’ প্রভৃতি নীতি দ্বারা যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছেন। মূলত প্লেটো তাঁর ‘The Republic’ গ্রন্থে যে আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দিয়েছেন তার মূল উদ্দেশ্য হলো সুন্দর বা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন।
প্লেটোর দার্শনিক চিন্তার প্রকৃতি: প্লেটোর দার্শনিক চিন্তা সুসংহতভাবে একটি বিশেষ ডায়ালগে প্রকাশিত হয় নি। বিভিন্ন ডায়ালগের মধ্য দিয়ে তাঁর দার্শনিক চিন্তার ক্রমবিকাশ ঘটেছে। একথা বলার অর্থ এই নয় যে, তাঁর দার্শনিক চিন্তা সুসংহত ও সুবিন্যস্ত নয়। প্লেটোর দার্শনিক মতবাদের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য, প্লেটোর ডায়ালগ রচনার কালানুক্রম অনুসরণ করে তাঁর ডায়ালগের সারবস্তুর সাথে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা না করে বিভিন্ন ডায়ালগের আলোচনার ভিত্তিতে তাঁর প্রধান প্রধান মতবাদগুলোর সাথে পরিচিত হওয়ার প্রচেষ্টাই হবে যুক্তিযুক্ত পন্থা।
প্লেটোর দর্শনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে বলা যেতে পারে যে, প্লেটো পূর্ববর্তী বিভিন্ন দার্শনিক চিন্তার সংযোজন প্লেটোর দর্শনে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাই বলে এরূপ সিদ্ধান্ত করা সমীচীন হবে না যে, তিনি ছিলেন সারগ্রাহী, বিভিন্ন দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোকে তিনি শুধু ঐক্যবদ্ধ করেছেন।
তিনি প্রাচীন দার্শনিক চিন্তাধারাকে সমালোচনামূলক বিচারের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তাঁর অনুসন্ধানের পরিসরকে বিস্ত ত করার জন্য। তাঁর আসল লক্ষ্য ছিল সত্যানুসন্ধান।
দার্শনিক জেলারের মতানুসারে প্লেটোর দর্শনের উৎপত্তির মূলে পূর্ববর্তী চারটি দার্শনিক চিন্তাধারার প্রভাব বা প্রবণতা (Philosophic tendencies) লক্ষ্য করা যায়। এগুলো হলো হিরাক্লিটাস, সক্রেটিস, পিথাগোরাস দর্শন সম্প্রদায় এবং এলিয়ার দার্শনিকবৃন্দের দার্শনিক চিন্তাধারা। হিরাক্লিটাসের দর্শনের সাথে প্লেটো পরিচিত হয়েছিলেন সক্রেটিসের সাথে তাঁর পরিচিতির পূর্বে এবং এ দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি অর্থাৎ সবকিছুই পরিবর্তনশীল, প্লেটোকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল জানের যথাযথ বিষয়টি কি তা নিরূপণ করার জন্য। এ ব্যাপারে সক্রেটিসের কল্যাণের স্বরূপ (Nature of good) অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা প্লেটোকে সহায়তা করেছিল। প্লেটো বুঝে নিয়েছিলেন যে, চরিত্র জ্ঞানের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। কিন্তু পিথাগোরাস দর্শন সম্প্রদায়ের সাথে পরিচয়, তাঁর চিন্তার রাজ্যে এক নবদিগন্তের সূচনা করল। এর থেকেই জন্মলাভ করল প্লেটোর দ্বৈতবাদ।
সক্রেটিসের, পিথাগোরাস সম্প্রদায়ের এবং এলিয়ার দর্শন, এ তিন উপাদান থেকেই জন্ম নিল প্লেটোর দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ- আকার বা ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদ (The doctrine of forms or ideas) এবং হিরাক্লিটাসের দর্শন জড়ের ব্যাখ্যার সূত্র যুগিয়েছিল। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ ধারণার জগতের একটা ক্ষীণ প্রতিলিপি এবং এ মতবাদ থেকেই প্লেটোর অন্যান্য সিদ্ধান্ত যৌক্তিকভাবে নিঃসৃত হয়েছে।
বার্ট্রান্ড রাসেলের মতেও প্লেটোর উপর বিশুদ্ধ দার্শনিক প্রভাব (Purely philosophical influences) বিস্তার করেছিলেন চারজন দার্শনিক। যথা: পিথাগোরাস, পারমিনাইডিস, হিরাক্লিটাস এবং সক্রেটিস। তাঁর মতে, পিথাগোরাসের কাছ থেকে প্লেটো তাঁর দর্শনে পেয়েছিলেন অরফিক উপাদান (Orphic elements), ধর্মীয় প্রবণতা, অমরতায় বিশ্বাস, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের অতিরিক্ত অন্য এক জগতের অস্তিত্বে বিশ্বাস, পুরোহিতের মনোভাব গুহার রূপকের সাথে জড়িত সব উপাদান, গণিতশাস্ত্রের প্রতি অনুরাগ এবং বুদ্ধির সাথে অতীন্দ্রিয়বাদ (Mysticism) কে সংমিশ্রিত করার প্রবণতা।
পারমিনাইডিসের কাছ থেকে তিনি এ বিশ্বাস প্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, সত্তা নিত্য ও অপরিণামী এবং যুক্তিসম্মতভাবে স্বীকার করে নেয়া যায় যে, সব পরিবর্তনই হলো অলীক। সক্রেটিসের কাছ থেকে সম্ভবত তিনি নৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার শিক্ষালাভ করেছিলেন।
প্রাকসক্রেটিস যুগের দার্শনিকবৃন্দের চিন্তাকে ‘কল্যাণের’ (The good) ধারণা যতখানি না স্থান অধিকার করেছিল তার থেকে অনেক বেশি প্রাধান্য লাভ করেছিল প্লেটোর চিন্তাতে এবং এ ব্যাপারে সক্রেটিসের প্রভাবকে অগ্রাহ্য করা খুবই কঠিন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, দার্শনিক চিন্তার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বা বিভিন্ন শাখায় তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যেতে সমর্থ হয়েছেন। জ্ঞান, সত্য ও কল্যাণনিষ্ঠ জীবনের যে আদর্শ তিনি স্থাপন করে গেছেন এর জন্য চিরকাল তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় অম্লান ও ভাস্বর হয়ে থাকবে।