প্লেটোর মতে আত্মার ন্যায়ধর্ম কিভাবে রাষ্ট্রের ন্যায়ধর্মে প্রতিফলিত হয় এ সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, প্লেটোর আত্মার ন্যায়ধর্ম কিভাবে রাষ্ট্রের ন্যায়ধর্মে কার্যকর হয় তা ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: প্লেটো তৎকালীন সমাজে প্রচলিত ন্যায়নীতি ধারণাকে খণ্ডনপূর্বক নিজস্ব ধারণা তথা মতামত প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন। তিনি বলেছেন, ন্যায়বিচার কোন কৃত্রিম বা বাহ্যিক ব্যাপার নয় এবং ন্যায় কোন বাহ্যিকভাবে আরোপিত শক্তি বা কর্তৃত্বের উপর নির্ভর করে না। ন্যায় প্রকৃতিগতভাবে মানুষের মধ্যে নিহিত। এটা মানবাত্মার যথার্থ স্বরূপ। প্লেটো ন্যায়ধর্মকে একটি সুস্থ দেহে সুন্দর মন হিসেবে কল্পনা করেছেন। তার কাছে ন্যায়বিচারের ধারণা ও আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। আদর্শ রাষ্ট্রকে যদি দেহরূপে কল্পনা করা হয়, তবে ন্যায়ধর্ম তার প্রাণ। বস্তুত তিনি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের জীবনের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখতে পান নি। তিনি আরও বলেছেন, নৈতিক উৎকর্ষের তিনটি গুণ বিদ্যমান। জ্ঞান, সাহস এবং আত্মসংযম। মূলত ন্যায়বিচার হলো পূর্বোক্ত তিনটির সম্মিলিত রূপমাত্র। তিনি আরও বলেছেন, রাষ্ট্র ব্যক্তির বৃহত্তর সংস্করণ মাত্র।

আত্মার ন্যায় ধর্ম রাষ্ট্রের ন্যায় ধর্মে প্রতিফলিত : প্লেটোর মতে আত্মার ন্যায়ধর্ম কিভাবে রাষ্ট্রের ন্যায়ধর্মে প্রতিফলিত হবে তা নিম্নে ব্যাখ্যা করা হলো:

প্লেটো ন্যায়ধর্মের অনুসন্ধান করতে গিয়ে মানবাত্মার বিভিন্ন উপাদানের সাথে রাষ্ট্রের অন্তর্গত বিভিন্ন শ্রেণির তুলনা করেছেন। তাঁর মতে, মানবাত্মা তিনটি অংশে বিভক্ত। যথা:

১. প্রজ্ঞা (Wisdom)

২. সাহস বা বিক্রম (Courage)

৩. প্রবৃত্তি বা কামনা (Appetite)

নিম্নে এ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হলো:

১. প্রজ্ঞা (Wisdom): যার মাধ্যমে মানুষ জানে ও শিখে থাকে। যেহেতু মানুষ জানতে শিখে তাই সে ভালোবাসতেও প্রস্তুত হয়।

২. সাহস বা বিক্রম (Courage): যার মাধ্যমে মানুষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। এটাও মানবাত্মার একটি অন্যতম দিক।

৩. প্রবৃত্তি বা কামনা (Appetite): যার মাধ্যমে মানুষের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়।

প্লেটোর মতে, মানুষের উপর্যুক্ত তিনটি গুণের প্রেক্ষিতে সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে তিনটি শ্রেণির মানুষ পরিদৃষ্ট হয়। যথা:

১. দার্শনিক বা অভিভাবক শ্রেণি (Philosopher or Guardian class)

২. সৈনিক বা যোদ্ধা শ্রেণি (Soldier class)

৩. উৎপাদক শ্রেণি (Productive class)

নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. দার্শনিক শ্রেণি (The philosophers class): এ শ্রেণি তাদের প্রজ্ঞার দ্বারা দেশ পরিচালনা করবে এবং মানবসমাজের উন্নততর জীবনযাপনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তাদের।

২. যোদ্ধা শ্রেণি (Soldier class): এ শ্রেণি রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে এবং তাদের সাহসের দ্বারা জীবন বিসর্জন দিয়ে হলেও দেশকে রক্ষা করবে।

৩. উৎপাদক শ্রেণি (Productive class): এ শ্রেণি দৈহিক পরিশ্রম করে মানুষের পার্থিব প্রয়োজন মিটাবে, প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান দিবে এবং দার্শনিক ও যোদ্ধা শ্রেণির আনুগত্য পোষণ করবে।

মানবাত্মার বিভাজন এবং নাগরিকদের বিভাজন করে প্লেটো বলেন, ব্যক্তির জীবনে ন্যায়পরায়ণতা নির্ভর করে মানবাত্মার গুণাবলির সুষ্ঠু সমন্বয় এবং সমঝোতার উপর। অপরদিকে, রাষ্ট্রীয় ন্যায়পরায়ণতা গড়ে উঠবে রাষ্ট্রের তিন শ্রেণির নাগরিকদের মধ্যকার সুন্দর ও সমন্বিত আন্তঃসম্পর্কের উপর। এ সম্পর্ক এবং আন্তঃসম্পর্কের সামান্য হেরফের হলেই প্লেটোর মতে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। প্লেটো আরও বলেছেন, প্রজ্ঞা, বিক্রম ও প্রবৃত্তি ধারাবাহিকভাবে দার্শনিক শ্রেণি, সৈনিক বা যোদ্ধা শ্রেণি এবং উৎপাদক শ্রেণির মধ্যে থাকবে এবং তারা তাদের কাজ যথাযথ ও সঠিকভাবে পালন করবে। সুতরাং এভাবেই আত্মার ন্যায়ধর্ম রাষ্ট্রের ন্যায়ধর্মে প্রতিফলিত হয়। Prof. Sabine এর ভাষায় বলা যায়, “Justice is the bond which holds a society together, a harmonious union of individuals each of whom has found his life work in accordance with his natural fitness and his training.”

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ন্যায়তত্ত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও প্লেটোর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করলে তার ন্যায়বিচার তত্ত্বের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। প্লেটো তার ন্যায়ধর্মে প্রত্যেক মানুষকে তার স্ব-স্ব বৃত্তিতে থাকার উপর জোর দিয়েছেন। এ ধারণা কোন আইনগত ধারণা নয়। এতে গণতান্ত্রিক নীতিবোধ বিঘ্নিত হলেও এটি একটি অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয়।