অথবা, প্লেটোর সাম্যবাদের সাথে আধুনিক সাম্যবাদের যেসব সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য রয়েছে তা আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: Plato এর ‘The Republic’ গ্রন্থে আলোচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সাম্যবাদ (Communism)। সাম্যবাদ প্লেটোর রাজনৈতিক দর্শনের এক অনবদ্য অবদান। তাঁর মতে, সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত না হলে জনগণ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। আর ন্যায়বিচার ব্যতীত প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের কথা চিন্তাই করা যায় না। রাষ্ট্রদর্শনে প্লেটোর সাম্যবাদের অবস্থান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
প্লেটোর সাম্যবাদ ও আধুনিক সাম্যবাদের তুলনা: আধুনিক মার্কসীয় সাম্যবাদ ও প্লেটোর সাম্যবাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য উভয়ই লক্ষ্য করা যায়। এগুলো পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করা হলো:
সাদৃশ্যসমূহ (Similarities): প্লেটোর সাম্যবাদ ও আধুনিক বা মার্কসীয় সাম্যবাদের মধ্যকার সাদৃশ্যসমূহ নিম্নরূপ:
১. সার্বিক কল্যাণ সাধন: রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের মন থেকে স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণতা দূর করে জনগণ তথা রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণ সাধন করা উভয় সাম্যবাদের মূল লক্ষ্য।
২. রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ: উভয় মতবাদেই একথা স্বীকৃত যে, সবকিছুই রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে।
৩. ব্যক্তিগত সম্পতি বিলোপ: উভয় ব্যবস্থাতেই ব্যক্তিমালিকানাকে অস্বীকার করা হয়েছে।
৪. ব্যক্তিস্বাধীনতা বিরোধী: উভয় মতবাদেই ব্যক্তিস্বাধীনতা অনুপস্থিত।
৫. আয় ও ব্যয়ের নীতি: সামর্থ্য অনুযায়ী আদায় এবং প্রয়োজনে সরবরাহ করা উভয় মতবাদে স্বীকৃত।
৬. আদর্শ সমাজব্যবস্থা গঠন: আদর্শ সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই উভয়ের লক্ষ্য।
৭. একই মানসিকতা: মানসিকতার দিক থেকে উভয়ের লক্ষ্য এক। উভয়ের জন্ম ও বংশ মর্যাদাহীন এক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রয়াসী।
৮. স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার: সাহিত্য ও শিল্পকলাকে উভয় দর্শনেই কায়েমি স্বার্থবাদীদের স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
৯. অসম প্রতিযোগিতা রোধ: উভয় মতবাদেই সমাজের অসম প্রতিযোগিতাকে রোধ করার কথা উল্লেখ রয়েছে।
১০. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিপক্ষে: প্লেটো ব্যক্তিস্বাতন্ত্রাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। আধুনিক সাম্যবাদীক ও বাক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে বিশ্বাসী নন।
১১. শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা: প্লেটোর সাম্যবাদের লক্ষ্য ছিল মানুষের জন্য শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। আধুনিক সাম্যবাদীরাও শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলতে চান।
বৈসাদৃশ্যসমূহ (Dissimilarities): প্লেটোর সাম্যবাদ ও মার্কসীয় বা আধুনিক সাম্যবাদের মধ্যকার পার্থক্য বা
বৈসাদৃশ্যসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১. প্লেটোর সাম্যবাদকে Half communism বলা হয়, কারণ Plato কেবল শাসক শ্রেণি ও যোদ্ধা শ্রেণির জন্য পরিবার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদের কথা বলেছেন। উৎপাদক শ্রেণি এ সাম্যবাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু আধুনিক সাম্যবাদ Full communism। এ সাম্যবাদ সকল শ্রেণির উপর একইভাবে প্রযোজ্য। এটা সর্বজনীন।
২. প্লেটোর সাম্যবাদে শাসক শ্রেণির উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু আধুনিক সাম্যবাদে শ্রমজীবী মানুষের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
৩. প্লেটোর সাম্যবাদে রাজনীতির উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রীয় ঐক্য সাধন। কিন্তু আধুনিক সাম্যবাদে রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আধুনিক সাম্যবাদ সর্বহারাদের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা বিধান করে।
৪. প্লেটোর সাম্যবাদের মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রীয় মঙ্গল কামনা। কিন্তু আধুনিক সাম্যবাদের লক্ষ্য হলো শ্রেণি ব্যবস্থার উচ্ছেদ করে শোষণহীন ও শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
৫. প্লেটোর সাম্যবাদে শ্রেণি সংঘাতের মাধ্যমে সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয় না। সেখানে শ্রেণিসংগ্রামের কোন অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আধুনিক সাম্যবাদের প্রধান স্তম্ভই হলো শ্রেণিসংগ্রাম।
৬. প্লেটোর সাম্যবাদে ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং এর সাথে পরিবার প্রথারও বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু মার্কসীয় সাম্যবাদে কেবল ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তির কথ্য বলা হয়েছে।
৭. প্লেটোর সাম্যবাদে আদর্শ রাষ্ট্রে শাসক, যোদ্ধা ও শ্রমিক তিনটি শ্রেণি রয়েছে। কিন্তু আধুনিক মার্কসীয় সাম্যবাদে শ্রেণির কোন অস্তিত্ব নেই। শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই আধুনিক সাম্যবাদের মূল লক্ষ্য।
৮. প্লেটোর মতে, সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হলেই আদর্শ রাষ্ট্র গঠন সম্ভব। কিন্তু আধুনিক সাম্যবাদে বলা হয়েছে, “সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হলেই রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটবে।”
৯. প্লেটোর সাম্যবাদে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যবোধই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু আধুনিক সাম্যবাদে জনগণের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যই বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
১০ . প্লেটোর সাম্যবাদ আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাসী নয়। কিন্তু আধুনিক সাম্যবাদ আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাসী।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে প্লেটোর সাম্যবাদ ও আধুনিক সাম্যবাদের মধ্যে বৈসাদৃশ্য থাকলেও সাদৃশ্যও পরিলক্ষিত হয় এবং এখানে উভয় সাম্যবাদের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে।