প্লেটোর সাম্যবাদ সম্পর্কে সমালোচনা কর।

অথবা, প্লেটোর ‘সাম্যবাদের সমালোচনা বর্ণনা কর। প্লেটো কী কারণে শাসকবর্গের উপর সাম্যবাদ কায়েম করতে চেয়েছিলেন?

অথবা, সমালোচনাসহ প্লেটোর সাম্যবাদ আলোচনা কর। প্লেটো শাসক রাজ্যের উপর কেন সাম্যবাদ কায়েম করতে চেয়েছিল।

উত্তরঃ ভূমিকা: প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের সাম্য, ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সাম্যবাদ ব্যবস্থার কথা বলেছেন তা মানুষের কতকগুলো ব্যক্তিগত অধিকারকে খর্ব করে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।

প্লেটোর সাম্যবাদের সমালোচনা: নিম্নে প্লেটোর সাম্যবাদের সমালোচনাসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়: প্লেটোর সাম্যবাদের একটি বড় সমালোচনা হলো এটা রাষ্ট্রের সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা এক প্রকারের আংশিক সাম্যবাদ। কারণ এটা কেবলমাত্র দু’শ্রেণির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। উৎপাদক শ্রেণিকে প্লেটো তাঁর সাম্যবাদে গৌণ স্থান দিয়েছেন।

২. সমাজ বিভক্তিকরণ: প্লেটো সামাজিক ঐক্যের পরিবর্তে সমাজকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করে ফেলেছেন। ঐক্যহীন সমাজ কখনো উন্নত হতে পারে না।

৩. জন্মগত অধিকার ক্ষুণ্ণ: ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং পরিবার মানুষের জন্মগত অধিকার। প্লেটোর সাম্যবাদে মানুষের জন্মগত অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে।

৪. পারিবারিক ঐতিহ্য অস্বীকার: পরিবারের বাইরে কারও অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। প্লেটো অভিভাবক এবং সৈনিক শ্রেণির জন্য পরিবার ব্যবস্থার বিলোপ করে পারিবারিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করেছেন।

৫. মানুষের প্রাকৃতিক অধিকারকে অস্বীকার: ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপের কথা বলে প্লেটো মানুষের প্রাকৃতিক অধিকারকে অস্বীকার করেছেন। ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষের ব্যক্তিত্ব ও সহজাত প্রবৃত্তির বিকাশে সহায়ক।

৬. আধুনিক সাম্যবাদ বিরোধী: প্লেটো বলেছেন, “সমাজবদ্ধ জীবনযাপনের জন্য রাষ্ট্র অপরিহার্য এবং রাষ্ট্রীয় শাসনভার অভিভাবক শ্রেণির হাতে অর্পণ করা উচিত।” কিন্তু আধুনিক সাম্যবাদ অনুসারে বলা হয় একবার সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে রাষ্ট্রের আর প্রয়োজন থাকবে না।

৭. শ্রেণি বিদ্বেষের জন্ম: প্লেটো সাম্যবাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বৃহত্তর জনসাধারণকে সাম্যবাদের আওতার বাইরে রেখে শ্রেণি বিদ্বেষেরই জন্ম দিয়েছে। সামাজিকভাবে তার সাম্যবাদ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের নৈতিক উৎকর্ষতা স্বীকার করে, তবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে।”

৮. সম্মানিত প্রতিষ্ঠান ও নৈতিকতাকে ধ্বংস: চিরাচরিত পারিবারিক প্রথার উচ্ছেদ করে প্লেটো প্রাচীন সম্মানিত প্রতিষ্ঠান ও পরীক্ষিত নৈতিকতাকে ধ্বংস করেছে। স্ত্রীদের যৌথকরণের মাধ্যমে একদিকে তিনি পারিবারিক পরিবেশ ও ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করেছেন, অন্যদিকে মানব মনের সুকুমার বৃত্তি যেমন- স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা ইত্যাদিকে বিসর্জন দিয়েছেন।

প্লেটো যে কারণে শাসকবর্গের উপর এ ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন: প্লেটো মনে করেন শাসক বা অভিভাবক শ্রেণি হলো প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারক ও বাহক। অভিভাবক শ্রেণির সাহসী অংশ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। জ্ঞানবান অংশ রাষ্ট্র প্রশাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এ অভিভাবক শ্রেণি থাকবে সকল প্রকার প্রবৃত্তি ও শঙ্কা থেকে মুক্ত। তারা হবে ন্যায়ের পতাকাধারী। অভিভাবক শ্রেণিকে প্লেটো স্বার্থপর হওয়ার সামান্যতম সুযোগ বা অবকাশ দিতে রাজি নন। আর তা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যেই তিনি শাসক শ্রেণির জন্য সম্পত্তি ও পরিবার উচ্ছেদের কথা বলেছেন।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, প্লেটোর সাম্যবাদের কিছু সমালোচনা থাকলেও প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্লেটো যে ধারণা পোষণ করেছিলেন, তা আধুনিক সাম্যবাদীদের লেখনীতে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। এজন্য Maxe বলেছেন, “Were he (Plato) alive today Plato be the reddest of reds.” ম্যাক্সের উক্তি অতিরঞ্জিত মনে হলেও একথা বলা যায় যে, আধুনিক কালের সাম্যবাদী চিন্তায় তার অনেকাংশই প্লেটো বহুপূর্বেই বর্ণনা করে গেছেন।