প্লেটো ও এরিস্টটলের তত্ত্বের তুলনামূলক পর্যালোচনা কর।
অথবা, অথবা, প্লেটো ও এরিস্টটলের চিন্তাধারার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: প্লেটো ও এরিস্টটলের মধ্যে শুরু ও শিষ্যের সম্পর্ক বিদ্যমান। তবে প্লেটো ও এরিস্টটলের মধ্যে দর্শনচিন্তা বিষয়ক কিছু মতভেদ বা পার্থক্য রয়েছে। তাদের দার্শনিক চিন্তাভাবনা এ জন্য যথেষ্ট ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে প্লেটো ও এরিস্টটল সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তা স্পষ্ট হয়ে উঠে।
প্লেটো ও এরিস্টটল সম্পর্কে আলোচনা: প্লেটো ও এরিস্টটল সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. ‘ন্যায়’ অনুসন্ধান: Plato স্বাভাবিকভাবে আশা করেছিলেন যে, বড় হয়ে তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবেন। কিন্তু তাঁর সময়ে এথেন্সে যে ‘উচিত অনুচিত’ এর প্রশ্নহীন ন্যায় অন্যায় মিশ্রিত শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল এর প্রতি তিনি সুবিধিত কারণেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। এছাড়া তৎকালীন এথেন্সবাসী কর্তৃক তাঁর শিক্ষাগুরু Socretis এর হত্যা তাঁকে (Plato) ভাবিয়ে তুলেছিল। অতঃপর তিনি ‘ন্যায়’ এর অনুসন্ধান শুরু করেন এবং মানুষের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে কল্পনার রাজ্যে ন্যায়ের ধারণা বিনির্মাণে সচেষ্ট হন। পক্ষান্তরে, Aristotle এর মতে, Socretis কে হত্যা করে গ্রিকরা দর্শনের বিরুদ্ধে প্রথম পাপ করেছিল। তাঁর মতে, রাষ্ট্র একটি সম্প্রদায় এবং সর্বাধিকের সর্বোচ্চ মঙ্গল সাধনই রাষ্ট্রের কাজ হওয়া উচিত, তাহলেই রাজনৈতিকভাবে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে।
২. রাষ্ট্রতত্ত্ব ও রাষ্ট্রের লক্ষ্য: Plato তৎতালে প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার উচ্ছেদ ও সংস্কারকল্পে প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিকপ্লস্বরূপ একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেন। তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে কাঠামো তৈরির মূল লক্ষ্য ছিল সমাজে ‘ন্যায়’ এর প্রতিষ্ঠা করা। অপরপক্ষে, Aristotle জৈবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রকে একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, শরীরের পূর্ণাঙ্গ রূপ ছাড়া প্রত্যেকটি অংশ যেমন নিষ্ক্রিয়, তেমনি মানুষ, গ্রাম, পরিবার প্রভৃতি রাষ্ট্রের উপাদানে পৃথকভাবে এদের কোন মূল্য নেই। কারণ রাষ্ট্রে ছাড়া এগুলো নিষ্ক্রিয়।
৩. শাসনতন্ত্র বা শাসক প্রসঙ্গ: Plato ‘ন্যায়’ এর জন্য আদর্শ রাষ্ট্র এবং আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য দার্শনিক রাজার কথা বলেছেন। তাঁর মতে, প্রজ্ঞার অধিকারী শিক্ষিত শ্রেণি রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। রাষ্ট্রের রাজা হবেন দার্শনিক। অপরদিকে, Aristotle এর মতে, একজন প্রজ্ঞাবান বা দার্শনিক ব্যক্তি কিংবা কিছুসংখ্যক দার্শনিক লোকের চেয়ে কম প্রজ্ঞাবান বা কম আনী অনেকগুলো লোকের চিন্তাভাবনা অধিকতর কার্যকরী এবং কল্যাণকর। Plato’র চিন্তাভাবনায় যেখানে সর্বাত্মকবানী সমাজতন্ত্র কিংবা স্বৈরতান্ত্রিকতার বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, সেক্ষেত্রে Aristotle এর চিন্তাচেতনায় গণতন্ত্রের অঙ্কুরোদ্যম আমরা লক্ষ্য করি।
৪. শিক্ষাব্যবস্থা প্রসঙ্গ: Plato তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের দার্শনিক রাজা তৈরির জন্য এক বিশেষ ধরনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থার কথা ব্যক্ত করেছেন। অপরদিকে, Aristotle রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কল্যাণকামী বাস্তবসম্মত সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছেন।
৫. সাম্যবাদ প্রসঙ্গ: Plato দার্শনিক রাজা তৈরির জন্য শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি দার্শনিক শাসকগোষ্ঠীর সাম্যের কথা বলেছেন। সেখানে তাঁদের সবার বৈশিষ্ট্য থাকবে সমান। কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি, পরিবার ও পিতৃমাতৃ পরিচয় থাকবে না। তাঁরা হবেন সবার মঙ্গলের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সমবৈশিষ্ট্যের নিঃস্বার্থ ব্যক্তিত্ব। অপরদিকে, Aristotle শুধু শাসক শ্রেণির সাম্যের কথা বলেন নি, তিনি বাস্তবতার নিরিখে সবার মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।
৬. পরিবার ও সম্পতি সম্পর্কিত ধারণা: Plato শাসক শ্রেণির ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবার না রাখার পক্ষপাতী। অপরদিকে, Aristotle ছিলেন বাস্তবতার পক্ষপাতী। তাঁর মতে, এ ব্যবস্থা মানবতাবিরোধী। তিনি শাসক শ্রেণির নিজস্ব পরিবার ও সম্পত্তি রাখার পক্ষে মত পোষণ করেছেন। কারণ পরিবার ও সম্পত্তিহীন শাসক শ্রেণি একটা অবাস্তব কল্পনামাত্র। বাস্তবে মানুষ কিছুটা স্বার্থপরও বটে। তাই এ ব্যবস্থা (Plato বর্ণিত ব্যবস্থা) প্রতিষ্ঠিত হবে না।
৭. নাগরিকতা প্রসঙ্গ: Plato ও Aristotle উভয়েই নাগরিকতার ধারণা দিতে গিয়ে সমাজের নিচুশ্রেণি ও বিদেশিদের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েছেন। তাঁদের মতে, নাগরিক হবে নাগরিক পিতামাতার সন্তান। নাগরিক হবে রাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা এবং রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিবর্গ, যা বাস্তবতা সম্পর্কিত।
৮. দাসপ্রথা প্রসঙ্গে: Plato দাসপ্রথা সম্পর্কে তেমন কিছু বলেন নি। তবে তাঁর বর্ণনায় উৎপাদক শ্রেণিকে সমাজে আমরা দাস তুল্য দেখতে পাই। অপরদিকে, Aristotle এর মতে, দাস হলো পরিবারের অংশ। পরিবারের কাজকর্ম সঠিকভাবে করার জন্য পরিবারে দাস থাকবে। কিন্তু তারা রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাবে না। তবে তাদের প্রতি দাস মালিকগণ অত্যধিক অত্যাচার করলে রাষ্ট্র তাদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে।
৯. বিপ্লব তত্ত্ব প্রসঙ্গ: Aristotle রাষ্ট্রে সংঘটিত বিপ্লব সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, রাষ্ট্রের মধ্যে যে কোন ধরনের পরিবর্তন হলে তা যেহেতু রাষ্ট্রের অধিবাসীদের জন্য এবং রাষ্ট্রের নাগরিকগণের দ্বারাই সংগঠিত হবে, তাই রাষ্ট্রের মধ্যে যে কোন অংশের পরিবর্তনই বিপ্লব বলে পরিগণিত হবে। অন্যদিকে, Plato এ সম্পর্কে তেমন কিছু বলেন নি। তবে তাঁর ‘Republic’ এবং ‘Dialogue’ পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারি যে, তাঁর মতে, রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হলে তা বিপ্লব বলে পরিগণিত হবে, যা আমরা পরবর্তী কালে কার্ল মার্কসের বিপ্লব তত্ত্বে লক্ষ্য করি এবং বাস্তবতায় দৃষ্ট হয়।
১০. রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রবর্তনের ক্ষেত্রে: Plato তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে ভাববাদী ধারণায় উপমা ও রূপকের সাহায্যে প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীতে একটি বিকল্প রূপ দাঁড় করিয়েছেন এবং এক্ষেত্রে আমরা তাঁর ‘Republic’ এবং ‘The Laws’ গ্রন্থের মধ্যে চিন্তাধারার বিবর্তন লক্ষ্য করি। অপরদিকে, Aristotle এর বক্তব্যগুলো সঠিক যুক্তিবিদ্যার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি বাস্তবতা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে বাস্তবের কাছাকাছি আদর্শকে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, কল্পনাপ্রবণ Plato তাঁর কল্পনার রাজ্য (ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাকল্পে) তৎকালে প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিকল্প ও বিপরীত রূপ হিসেবে নানা রকম চিত্রকল্প রাষ্ট্রচিন্তায় অঙ্কন করেছেন। অপরদিকে, Aristotle Plato থেকে ধারণা নিয়ে সেখানে জীবনের অভিজ্ঞতা এবং বাস্তবতার মিশেল দিয়ে বাস্তবের কাছাকাছি আদর্শকে অঙ্কন করে গেছেন। শেষে একথাও বলা যায় যে, Aristotle প্রকৃত প্রস্তাবেই বাস্তববাদী দার্শনিক ছিলেন এবং তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন কল্পনাবিলাসী Plato’র রাজনৈতিক দর্শন থেকে একধাপ এগিয়ে রাজনৈতিক চিন্তার সৌধ পুনর্নির্মাণ করেছেন শুধু।