উত্তর : ভূমিকা: ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে ফরায়েজি আন্দোলন একটি চিরস্মরণীয় ঘটনা। এ আন্দোলনের মহানায়ক ছিলেন সময়োপযোগী বলিষ্ঠ পুরুষ হাজি শরিয়তুল্লাহ। পলাশির যুদ্ধের পর মুসলিম সম্প্রদায়ের সার্বিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। আঠারো শতকের শেষভাগে বাংলার মুসলিম সমাজ বিভিন্নভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে যখন দুর্দশাগ্রস্ত তখন ফরায়েজি ও ওহাবি আন্দোলন মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে। ফরায়েজি আন্দোলন মুসলিম সম্প্রদায়কে সংঘবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও ফরায়েজি আন্দোলন মুলত ধর্মীয় সংস্কারসমূলক আন্দোলন ছিল কিন্তু পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এ আন্দোলন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নেয়। সুতরাং উপমহাদেশের রাজনীতি অধ্যয়নের ফরায়েজি আন্দোলনের গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী।
হাজি ফরায়েজি আন্দোলনের দুদুমিয়ার অবদান : শরিয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র দুদুমিয়া এ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। দুদুমিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। এ সময় এ আন্দোলনের সমর্থকের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৮০ হাজার দুদুমিয়া প্রভাবে সমগ্র পূর্ববাংলায় প্রভাবিত হয়। পিতার তুলনায় তিনি ছিলেন বেশি বিচক্ষণ ও রাজনীতিতে ছিলেন সঠিক সচেতন। সাংগঠনিক কাজের সুবিধার জন্য তিনি বাংলাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেন এবং প্রত্যেকটি অঞ্চলে একজন খলিফা নিয়োগ করেন এবং অনুসারীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতেন। জমিদারদের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য তিনি খুব দ্রুত একটি লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করে জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি প্রথমে ঘোষণা করেন বিভিন্ন পূজা সাধনে কোনো মুসলমান কৃষক কর প্রদান করবে না। ১৮৪১ থেকে ১৮৪৬ সাল পর্যন্ত জমিদার ও নীল কুঠিয়ালদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংঘর্ষে লিপ্ত হন। ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে দুদুমিয়াকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষী দাঁড় করাতে না পারায় আদালত তাকে বেকসুর খালাস দিতে বাধ্য হয়। ১৮৫৭ সালৈ সিপাহি বিদ্রোহের সময় দুদুমিয়ার সমর্থকরা সিপাহিদের সমর্থনে বিভিন্ন স্থানে সভা-সমিতিতে মিলিত হয়ে সিপাহিদের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন। সরকার এ সময় দুদুমিয়াকে গ্রেফতার করে এবং তাকে কলকাতার জেলখানায় প্রেরণ করে। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক জ্যামস ওয়াইক বরেন, দুদুমিয়া আদালতে বলেছিলেন আমার আহ্বানে ৪০ হাজার লোক সাড়া দিবে এবং আমি তাদেরকে যেভাবে আদেশ করব তারা তাই পালন করবে। দুদুমিয়ার সমর্থকেরা এভাবেই নেতার আহ্বানে সাড়া দিতেন। দুদুমিয়ার অনুপস্থিতিতে ফরায়েজি আন্দোলনের সমর্থকেরা মেহেদীগঞ্জ থানার বিভিন্ন স্থানে এবং ঢাকা ও বাখেরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। ১৮৬০ সনে দুদুমিয়া জেল থেকে ছাড়া পান এবং ঢাকার ১৩৭ নং বংশাল রোডে বসতি স্থান করে কিন্তু মাত্র ২ বছর পর ১৮৬২ সালে তিনি পরলোক গমণ করেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ফরায়েজি আন্দোলনের গতিস্থিমিত হয়ে যায়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ফরায়েজি আন্দোলন শুরু পর্যায়ে ছিল নিছক একটি সরকার বিরোধী আন্দোলন এবং শেষের দিকে কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপ লাভ করে। ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব যখন দুদুমিয়ার হাতে চলে আসে তখন এ আন্দোলন কেবল ধর্মীয় সংস্কারবাদী আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকে নি। এটি শোষক গোস্ঠীর অত্যাচার থেকে অসহায় দরিদ্র কৃষক শ্রেণিকে রক্ষার জন্য প্রতিরোধ আন্দোলনের সূচনা করে। তিনি শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন। ফরায়েজি আন্দোলনের প্রকৃতি বিচার করলে দেখা যায়, এ আন্দোলন শেষ পর্যায়ে সামাজিক, রাজনৈতিক, এমনকি শ্রেণিবাদী সংগ্রামের চরিত্র লাভ করেন।