বঙ্গবন্ধুরে সরকারের শাসনভার গ্রহণের সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধর।

অথবা, ১৯৭১ সালের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের চিত্র আলোচনা কর।

উত্তরা ভূমিকা: ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলার মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। পাকিস্তান বাহিনীর জ্বালাও পোড়াও নীতির কারণে বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে বিধ্বস্তরূপ লাভ করে। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বাংলার প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে। দেশের আইনশৃঙ্খলার চরম অবক্ষয় হয়। সারা দেশে ডাক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তার বিভাগ অচল হয়ে পড়ে। এছাড়া ব্যাংকগুলো বন্ধ ছিল এবং এর তহবিল শূন্যের কোটায় ছিল। নিচে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলার চিত্র তুলে ধরা হলো:

কৃষিক্ষেত্র: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খাদ্যশস্যের সংকট দেখা দেয়। এছাড়া এ সময় পাক বাহিনীর পরাজয় সুনিশ্চিত হওয়ায় তারা এ অঞ্চলের গুদামে মজুদ খাদ্যশস্য, খাদ্যবীজ, সার, কীটনাশক ঔষধ, মাঠের গভীর নলকূপ ধ্বংস করতে থাকে।

এছাড়া দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ হওয়ায় কৃষি উপকরণ ক্রয়ে কৃষকের হাতে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তান বাহিনী ও এদেশীয় দোসররা হালের গরু জবেহ করে ভক্ষণ করে। এতে হাল চাষে গবাদি পশুর সংকট দেখা দেয়।
এ সংকটময় পরিস্থিতিতে নতুন সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে কৃষিঋণ প্রদান, বীজ সংগ্রহ, নলকূপ মেরামত ইত্যাদি বিষয়ে দ্রুত কাজ করতে হয়।
এ পরিস্থিতিতে কৃষি পুনর্বাসন ছিল একটা জটিল প্রক্রিয়া। পাকিস্তান আমলে তারা এ অঞ্চলের কৃষি উন্নয়নে কোনো
অবদান রাখেনি।

খাদ্য সংকট: কৃষি ক্ষেত্রের এ বিধ্বস্ত অবস্থা নব্য স্বাধীন বাংলায় খাদ্য সংকটের সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধুর সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৪০ লক্ষ টন। এর মধ্যে সরকার মাত্র ৪ লক্ষ টন খাদ্য মজুদ পান। এ খাদ্য সংকটের সময়েও সরকারকে ৯৩ হাজার বন্দি সৈন্য, ৫০-৬০ হাজার রাজাকার ও দালাল এবং প্রায় সোয়া লক্ষ ভারতীয় সৈন্যদের খাদ্য সরবলই করতে হতো। নতুন সরকারের জন্য এটা অনেক চ্যালেঞ্জের ছিল।

বিপর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তার পূর্বে গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০ এর নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশের প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। যুদ্ধের সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়।
এ প্রেক্ষিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত আসবাবপত্র, বেঞ্চ, টেবিল, চেয়ার ইত্যাদি মেরামত বা নতুন করে ক্লাস শুরু করা নতুন সরকারের জন্য এক কঠিন কাজ ছিল।
তাছাড়া স্বাধীন বাংলার জন্য উপযোগী পাঠ্য বই তৈরি করাও ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক শিক্ষক শহিদ হওয়ায় শিক্ষক সংকটও প্রকট আকার ধারণ করে। এ সময় শিক্ষকদের ৯ মাসের বেতন বন্ধ ছিল। তা পরিশোধ করাও কষ্টসাধ্য ছিল।

সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস সাধন: ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনী এদেশে অনেক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ সময় প্রায় ৪৩ লক্ষ বসতবাড়ি, ৩ হাজার অফিস ভবন, ১৮ হাজার প্রাইমারি স্কুল, ৬ হাজার স্কুল ও মাদ্রাসা ধ্বংস করে। এছাড়া প্রায় ৯ শত কলেজ ভবন ও ১৯ হাজার গ্রাম্য হাটবাজার পুড়িয়ে দেয়। এগুলো পুনর্নির্মাণে অনেক অর্থের প্রয়োজন ছিল। ফলে ভারতে প্রায় ১ কোটি লোক শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরে উদ্বাস্ত হওয়া লক্ষ লক্ষ পরিবারকে পুনর্বাসন করাও বঙ্গবন্ধু সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।

যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপর্যয়: ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় সারা দেশে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যুদ্ধের সময় সারা দেশে প্রায় ২৭৪টি ছোট বড় সড়ক সেতু ও ৩০০টি রেল সেতু ধ্বংস করা হয়। রেল লাইনেরও ক্ষতিসাধন হয় এ সময়। ১৫০টি বগি এবং অনেকগুলো রেল ইঞ্জিন অকেজো হয়ে পড়ে। যুদ্ধের সময় শতকরা ৮৫টি জলযান ধ্বংস করা হয় এবং মালবাহী প্রায় ৩০০০ নৌকা ডুবিয়ে দেওয়া হয়। তৎকালীন চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন পোতার কারণে বন্দর দুটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। এছাড়া বিমান বন্দরগুলোও এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা মোকাবিলা করা নবগঠিত বাংলাদেশের পক্ষে অনেক কঠিন ছিল।

বিদ্যুৎ ব্যবস্থার বিপর্যয়: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় সারা বাংলায় বিদ্যুতের বিপর্যয় সাধিত হয়। সারা দেশে বিদ্যুতের সাব স্টেশনগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লাইন ও বিদ্যুৎ পোলগুলো যুদ্ধের সময় ধ্বংস করা হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনের সময় এবং পুনর্নির্মাণে কোনো খুঁটি বা সরঞ্জাম মজুদ ছিল না।

টেলিযোগাযোগের দুরবস্থা: মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার সাথে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরসমূহের এবং বিদেশের সাথে টেলিযোগাযোগ ধ্বংস হয়ে পড়ে। পাকিস্তান বাহিনী টেলিযোগাযোগের যেসব নথিপত্র আছে তা পুড়িয়ে ফেলে। টেলিযোগাযোগ পুনঃস্থাপনে অনেক অর্থ এবং ৫০০০ টেলিফোন সেট এবং ৩১টি ট্রাঙ্ক লাইন স্থাপন প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নতুন সরকারের জন্য এটা কষ্টসাধ্য ছিল।
সংবিধান ও আইনের শূন্যতা: নতুন সরকারের হাতে কোনো সংবিধান ছিল না। তাদের কাছে ঔপনিবেশিক আইন ব্যবস্থা থাকায় স্বল্প সময়ে সংবিধান প্রণয়ন করতে হয়।

অর্থনৈতিক অবস্থা: দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ হওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়ে। এছাড়া আত্মসমর্পণের পূর্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাংকসমূহে গচ্ছিত কাগজের নোটগুলো পুড়িয়ে ফেলে এবং অনেক স্বর্ণ অলংকার লুট করে নেয়।

এছাড়া ব্যাংকের নথিপত্রগুলোও তারা ধ্বংস করে ফেলে। পাকিস্তান সময়ে উচ্চ পর্যায়ের বেশিরভাগ কর্মকর্তা পাকিস্তানের বা অবাঙালি হওয়ায় বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দক্ষ কর্মকর্তার অভাব দেখা দেয়।

এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অনেক মিল জনবলের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে। এগুলো চালু করার মতো কাঁচামাল ও পর্যাপ্ত অর্থ নব্য স্বাধীন দেশের ছিল না। ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে। যা বঙ্গবন্ধুর সরকারকে কাটিয়ে উঠতে অনেক শ্রম দিতে হয়।

প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দক্ষ প্রশাসকের অভাব: নব্য স্বাধীন দেশের জন্য দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার যোগান দেওয়া নব্য বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এর অন্যতম কারণ পাকিস্তান আমলে এ অঞ্চলের জনশক্তিকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করা। এ সময় দক্ষ প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, ব্যাংকার এবং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পাকিস্তান আমলে অবাঙালিরা এসব কাজ নিয়ন্ত্রণ করতো বিধায় নতুন রাষ্ট্রে দক্ষ কর্মীর অভাব দেখা দেয়।

এছাড়া বাংলাদেশের নতুন সরকারের শাসনে আরো অনেক সমস্যার উদ্ভব হয়। উপরের সমস্যাবলি ছাড়াও নতুন সরকারকে আরো অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

ক. মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দালালদের আটক করে বিচারের সম্মুখীন করা।

খ. পাকিস্তানে আটক প্রায় ৪ লক্ষাধিক বাঙালিকে ফিরিয়ে আনা।

গ. মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার ও মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন করা এবং শহিদ ও হতাহত মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে সহায়তা করা।
ঘ. বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় সোয়া লক্ষ ভারতীয় সৈন্যকে ভারতে ফেরত পাঠানো।

ঙ. জাতিসংঘসহ সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করা।

চ. স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি লাভ করা।

ছ. দেশ গঠনে আন্তর্জাতিক অনুদান লাভ করা।

জ. সীমান্ত চোরাচালান বন্ধ করা।

এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিনষ্ট করার জন্য তখন বিভিন্ন চক্রান্ত হচ্ছিল। এর থেকে জাতিকে মুক্ত করা এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সচেষ্ট হন। নতুন স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশ এর সামনে এ চ্যালেঞ্জগুলো আসতে থাকে এবং এর প্রতিকারে নতুন সরকার নিজেদের আত্মনিয়োগ করেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা বাংলাদেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এ নব্য স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়ে। এর থেকে উত্তরণে নতুন সরকার নানা সমস্যার সম্মুখীন হলেও তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করে।