বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও পরবর্তী পরিস্থিতি বিস্তারিত আলোচনা কর।

অথবা , বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও গ্রেফতার সম্পর্কে আলোচনা কর।

উত্তর। ভূমিকা: বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই ছিল মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা। প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা ঘোষণায় একমত হতে পারেনি সে সময় আওয়ামী লীগ। এজন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এতে বাঙালি জাতি মানসিকভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। পরিপ্রেক্ষিতে অসহযোগ আন্দোলন তীব্র হলে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তাকে গ্রেফতার করে নেওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।

স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট: ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তর
করতে টালবাহানা শুরু করে। এ সময় মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক হলেও কোন সুরাহা হয় না। ফলে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরোক্ষভাবে প্রথমে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। এ বক্তব্যের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ৭ মার্চের ভাষণের পর পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর টনক নড়ে। তারা গোপনে গোপনে যড়যন্ত্র শুরু করে। এ সময় বসে ইয়াহিয়া ও মুজিব বৈঠক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। এদিকে পশ্চিমা গোষ্ঠী বৈঠকের নামে কালক্ষেপণ করতে থাকে।’

গোপনে পশ্চিমা পাকিস্তানিরা ট্যাঙ্ক, কামান, ভারী মেশিনগান পূর্ব পাকিস্তানে আনয়ন করে। হঠাৎ ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালির উপর আক্রমণ চালায়। এ সময় মধ্যরাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও গ্রেফতারের প্রেক্ষাপট: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগেই বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালি জাতির একমাত্র পথ যুদ্ধের পথ। তাই তিনি ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে জাতিকে প্রস্তুত থাকতে বলেন। অবশেষে ২৫ মার্চ কালরাতে তাই ঘটে। তিনি অবশ্য স্বাধীনতার ঘোষণা আগেই লিখে রেখেছিলেন এবং ওয়্যারলেস মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অতঃপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে আসে। নিচে এর প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হলো:

i. ১৯৭০ এর নির্বাচন: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় তখন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পারেন এ জাতির মুক্তির একমাত্র পথ হলো যুদ্ধের পথ। তাই তিনি ৭ মার্চ পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন।

ii. ইয়াহিয়ার সাজানো বৈঠক: ইয়াহিয়া ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বৈঠকের সাজানো নাটক করেন। এতে আসলে কোন সুরাহা হয় না। তাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ডাকেন।

iii. ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র: ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছিলেন। নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী আখ্যায়িত করেন। মূলত এটা ছিল একটা মিথ্যা।

iv. বাঙালি জাতির উত্থান: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ ও ৩ মার্চ হরতালের ডাক দিলে সরকার কারফিউ জারি করে। ছাত্র-জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে। সেনাবাহিনী গুলি চালায়। এতে শত শত লোক হতাহত হয়। প্রতিবাদে জেগে উঠে বাঙালি জাতি। চারদিকে বিদ্রোহ আর গগনবিদারী চিৎকার “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর।”

v. ৭ মার্চের ভাষণ: রেসকোর্স ময়দানে লাখ মানুষের জমায়েতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দেয়- “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব। ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” মূলত এ ভাষণই ছিল স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণা। অবশ্য তিনি ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন।

vi. ৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্য: ৭ মার্চের ভাষণের, বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় এটাই মূলত ছিল স্বাধীনতার আগাম ঘোষণা। এর বৈশিষ্ট্য:

ক. নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।

খ. সামরিক আইন প্রত্যাহার ও বাতিল।

গ. সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া।

ঘ. গণহত্যার বিচার ও শাস্তির দাবি।

vii. অসহযোগ আন্দোলন : কার্যত ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সরকারি-বেসরকারি, সচিবালয়, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, নিম্ন আদালত, হাইকোর্ট, পুলিশ প্রশাসন, ব্যাংক-বিমা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেলওয়ে সরকারের নির্দেশ অমান্য করে।

viii. মুজিব-ইয়াহিয়া-জুট্টো বৈঠক: অবস্থা উপলব্ধি করে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা শুরু করে। তখনো অসহযোগ প্রত্যাহার হয়নি। ১৯ মার্চ ভুট্টো আলোচনায় যোগ দেন। ঐকমত্যে ব্যর্থ হয়ে ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ত্যাগ করে। তারপরই শুরু হয় ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড অপারেশন সার্চলাইট।

ix. অস্ত্রের মহড়া: মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক চলাকালে পশ্চিম পাকিস্তানিরা গোপনে এদেশে ট্যাঙ্ক, গোলা-বারুদ, ভারী মেশিন, অস্ত্রশস্ত্র সবই পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসে।

x. অপারেশন সার্চলাইট: বৈঠকে ঐকমত্য না হওয়ায় ১৭ মার্চ জেনারেল টিক্কা খান, লে. জে. খাদিম হোসেন ও রাও ফরমান আলী “অপারেশন সার্চলাইট” বা বাঙালির উপর নৃশংস হত্যাকাণ্ড পরিচালনার নীলনকশা প্রণয়ন করে।

xi. ২৫ মার্চ রাত এগারোটা: ২৫ মার্চ রাত এগারোটায় শুরু হয় অপারেশন সার্চলাইটের কর্মকাণ্ড। অতর্কিত বাঙালি জাতির উপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় পাক হানাদার বাহিনী। তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে হত্যাকাণ্ড চালায়।

xii. বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা: ২৫ মার্চ রাতে যখন পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির উপর

আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত, এ সময় রাত দেড়টার সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। “এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আর ওয়‍্যারলেস এর মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় সর্বত্র।”

xiii. বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পর পরই বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় ও নির্মম অত্যাচার চালানো হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যত দ্বিধাই থাকুক না কেন উপর্যুক্ত প্রেক্ষাপট উপলব্ধি করলে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে। পরে সর্বত্র তার বার্তা বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য তাকে গ্রেফতার করা হয় ও পশ্চিম পাকিস্তানে নেওয়া হয়।