বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব লিখ।

অথবা, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্বন্ধে তুমি কী আন?

উত্তরঃ ভূমিকা: বাঙালিদের চূড়ান্ত অর্জন হলো পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা। আর এ স্বাধীনতার অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির দাবিতে ছয়দফা দাবি উত্থাপন করে, শিকার হয় মামলার (১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে কিন্তু পাকিস্তানি দোসররা ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। অবশেষে ৭ মার্চের জ্বালাময়ী ভাষণে বাঙালি জনগণ পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে যার সুবাদে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে।

পৃথিবীর পৌরবময় ভাষণ: বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। তার ভাষণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ভাষণের সাথে তুলনা করা হয়। আব্রাহামের ভাষণ ছিল মাত্র ৩ মিনিট আর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল প্রায় ১৮ মিনিট। তবে ৭ মার্চের এ ভাষণ একদিনের প্রেক্ষাপটে আসেনি। দীর্ঘ রাজনীতিক বৈষম্য, শোষণ ও নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে এ ভাষণের আবির্ভাব হয়েছে। ৭ মার্চ এর ভাষণ ছিল মূলত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। পরোক্ষভাবে বলা যায় এটাই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণা।

১৯৭১ এর ৭ মার্চের ভাষণ: ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালির ইতিহাসের এক মাহেন্দ্রক্ষণ। সকাল থেকেই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র-জনতা-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা দলে দলে সমবেত হতে থাকে। সমগ্র পাকিস্তানের জন্য এটি ছিল অন্তিম মুহূর্ত।

মার্চের ভাঙ্গা যেরূপ ছিল: “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা।”

৭ মার্চের ভাষণের পর্যালোচনা: আওয়ামী নেতারা একমত হন যে, তারা সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে কৌশলে ঘোষণা দেওয়া হবে। কেননা তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা হতো। সেক্ষেত্রে বিশ্বে বাঙালির নিয়মতান্ত্রিক স্বাধিকার আন্দোলন যে সমর্থন পেয়েছিল তা প্রত্যাহার হতে পারতো। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে ৪টি দাবি উত্থাপন করা হয়। যথা:

ক. সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।

গ. গণহত্যার তদন্ত ও বিচার করতে হবে।

খ. সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।

ঘ. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে গেরিলা যুদ্ধের দিকনির্দেশনাও প্রদান করেন। তিনি ঘোষণা করেন, “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।” বাঙালির মনোবল জাগ্রত করতে দার্শনিক নেতার মতো তিনি ঘোষণা করেন “আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।” তিনি পাকিস্তানি সেনাদের ‘ভাতে মারব, পানিতে মারব’ গেরিলা কৌশল ঘোষণা করেন। ভাষণের শেষ দিকে তিনি বলেন “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেন, “আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি, বাঙালি যেন যুদ্ধ চালিয়ে যায়।” বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান না করলেও ছাত্র-জনতা-ইপিআর বাঙালি সেনা সদস্যদের কাছে তা ছিল গ্রিন সিগন্যাল।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ৭ মার্চের ভাষণ ছিল মূলত পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার আগাম বার্তা। এটাকে স্বাধীনতার পরোক্ষভাবে ঘোষণাও বলা যেতে পারে। কারণ এ ভাষণের ফলে বাঙালি জাতি মানসিকভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অতঃপর এরই পরিপ্রেক্ষিতে অসহযোগ, ২৫ মার্চের রাতে গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুর লিখিতভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা চলে আসে।