অথবা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির কৃতিত্ব বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের জন্য পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে সকলের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। তিনি কোনো বিশেষ রাষ্ট্র বা বৃহৎ শক্তির পক্ষ অবলম্বন না করে জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ও যুগোপযোগী পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে গুরুত্ব প্রদান করেন।
পররাষ্ট্রনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাফল্য : বঙ্গবন্ধুর যোগ্য নেতৃত্বে ও দক্ষ পররাষ্ট্রনীতির ফলে দ্রুত পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য আসতে থাকে এবং বহির্বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। নিচে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির সফলতা মূল্যায়ন করা হলো:
১. ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার: মুক্তিযুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় সৈন্য অংশগ্রহণ করে। তাদের নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। বিপুল পরিমাণ ভারতীয় সৈন্য ভারতে ফেরত পাঠানো ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মাত্র ১২ মার্চ ১৯৭২ বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গাষ্ঠীকে বুঝাতে সক্ষম হন যে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতীয় সৈন্যদের আর কোনো প্রয়োজন নেই। এত অল্প সময়ের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে স্বদেশে পাঠানো বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম সাফল্য ছিল।
২. বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন: বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন ছিল বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির সাফলের অন্যতম দিক। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ও বন্ধুর নিদর্শন হিসেবে এ মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেন। ১৯৭২ সালের ৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী নবায়নযোগ্য ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এর মাধ্যমে বন্ধুত্ব দুদেশের মধ্যে সুদৃঢ় হয়। এ চুক্তির মাধ্যমে দুদেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিল্প, সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
৩. যুদ্ধবন্দি সমস্যা নিরসন: যুদ্ধবন্দি সমস্যা নিরসনের জন্য বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ বিষয়ে ভারতের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন দেশের সহায়তা নিয়ে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধবন্দি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। ১৯৭৩ সালে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুন্যাল) বিল পাস করে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু বহির্বিশ্বের স্বীকৃতির প্রতি গুরুত্বারোপ করে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে প্রজ্ঞার পরিচয় দেন।
৪. বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি লাভে সমর্থ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম সাফল্য ছিল বহির্বিশ্বের সমর্থন লাভ ও স্বীকৃতি প্রদান। তার কূটনৈতিক উদ্যোগের ফলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এছাড়া ইউরোপীয় দেশসমূহ পাকিস্তানসহ বিভন্ন মুসলিম দেশের স্বীকৃতি লাভের ক্ষেত্রে সফলতা দেখাতে সক্ষম হয়। যদিও চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সাথে সুসম্পর্ক ছিল না। বঙ্গবন্ধুর দক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে ১২১টি দেশের স্বীকৃতি লাভ করে।
৫. আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভে সমর্থ : বঙ্গবন্ধুর দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতার এবং পররাষ্ট্রনীতির ফলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় দ্রুত সদস্যপদ লাভে সমর্থ হয়। ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সংস্থারও সদস্য পদ লাভ করে। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। এছাড়া কমনওয়েলথ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, ইউনেস্কো, ইসলামি সম্মেলন সংস্থা, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন প্রভৃতি সংস্থায় দ্রুত সদস্য পদ লাভ করে যা বঙ্গবন্ধুর সফল পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম দিক।
৬. বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ: যুদ্ধবিধান্ত দেশের সাহায্য ও পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। যেমন- জাতিসংঘ, ইসলামি সম্মেলন সংস্থা প্রভৃতি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন সহযোগিতা কামনা করেন।
৭. বৈদেশিক সাহায্য লাভ: বঙ্গবন্ধু সফল পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ থেকে সাহায্য সহযোগিতা লাভ করেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে দেশ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। এ লক্ষ্যে তিনি পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে বহির্বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য ছিল শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান, বন্ধুত্বপূর্ণ ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি। এ পররাষ্ট্রনীতির ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের সকল দেশের কাছে সৌহার্দ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানের বার্তা পৌছে দেন। ফলে দ্রুত বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার অবস্থান সুদৃঢ় করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন।