বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব পর্যালোচনা কর।

অথবা, অসহযোগ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধর।

উত্তর। ভূমিকা: ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন এর মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করে ১৯৭০ সালের নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বিভিন্ন টালবাহানা ও সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ এর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। এ অসহযোগ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে রূপ লাভ করে।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব: ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলমান অসহযোগ আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রথম সূচনা। নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের অযথা গড়িমসি, প্রতারণা এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর অসহযোগিতা ছিল এ অসহযোগ আন্দোলনের প্রধান কারণ। নিচে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু: ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে এবং প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানি বাহিনী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে পূর্ববাংলার জনগণ পাকিস্তানি সরকারের আদেশ নির্দেশ অমান্য করতে থাকে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে। দেশ পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। ফলে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।

২. পূর্ব পাকিস্তানে স্বতঃস্ফূর্ত অসহযোগ আন্দোলন: পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শুরু হয়ে যায় অসহযোগ
আন্দোলন। সর্বস্তরের জনতা, আওয়ামী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট মার্কসবাদী, লেনিনবাদী, ভাসানীর ন্যাপ প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনসমূহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে।

৩. প্রশাসনিক ব্যবস্থায় স্থবিরতা: পাকিস্তানি প্রশাসন ব্যবস্থা পূর্ব পাকিস্তানে অচল হয়ে পড়ে। দেশ পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, কলকারখানা সব বন্ধ হয়ে যায়। পূর্ব বাংলার জনগণ ট্যাক্স ও খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। বিক্ষুদ্ধ জনতা বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে থাকে।

৪. প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু: অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন তাতে সমগ্র জনতা স্বাধীনতা যুদ্ধে অনুপ্রাণিত হয়ে স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসহ বিভিন্ন দলের সংগ্রাম প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যন্ত ব্যাপক প্রতিরোধ প্রস্তুতি গড়ে উঠে।

৫. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি: অসহযোগ আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সকল কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত হতে থাকে। তিনি হয়ে উঠেন পূর্ব পাকিস্তানে অবিসংবাদিত নেতা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা দ্বারা জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

৬. ৭ মার্চের ভাষণ: বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ। এ ভাষণের মাধ্যমেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সমগ্র পূর্ববাংলার জনতাকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীদের মোকাবিলার ঘোষণা দেয়। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণে একদিকে ছিল পাকিস্তানের শোষণ, দমন অন্যদিকে ছিল বাঙালিদের মুক্তির সংগ্রাম। ৭ মার্চের ভাষণ অসহযোগ আন্দোলনকে বেগবান করে এবং অসহযোগ আন্দোলনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জনগণ পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

৭. বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিকাশ: ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে বাঙালির জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে তার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে। সমগ্র পূর্ববাংলার জনগণ ক্ষুদ্র স্বার্থত্যাগ করে জাতীয় স্বার্থের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে। অসহযোগ আন্দোলন জাতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে এবং জনগণের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে।

৮. মুক্তির মন্ত্র প্রচার: অসহযোগ আন্দোলন জনগণের মধ্যে মুক্তির মন্ত্র প্রভার করে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ থেকে মুক্তি এবং শোষণহীন স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠায় মূল মন্ত্র ছিল মুক্তির সংগ্রাম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার প্রতিটি নরনারীকে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান।

৯. মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান: অসহযোগ আন্দোলন জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের আহবান জানিয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধের আহবানে পূর্ববাংলার জনগণ মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ এর ঘোষণা ছিল মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষিত করে। যাতে বলা হয় স্বাধীন কর, স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। গ্রামে গ্রামে দুর্গ কর মুক্তিবাহিনী গঠন কর, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। মুক্তি যদি পেতে চাও বাঙালিরা এক হও। এ সকল শ্লোগানেও মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে পূর্ব বাংলার আপামর জনতা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ অপরিসীম। এ আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব প্রস্তুতি পর্ব। এ আন্দোলন পাকিস্তানের শাসনকে দুর্বল করে দেয়। বাঙালিরা প্রমাণ করে যে তাদের নিকট পাক সরকারের নির্দেশের কোনো মূল্য নেই। পূর্ব পাকিস্তানে প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে। অসহযোগ অন্দোলন বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে শিক্ষা দিয়েছে। অসহযোগ আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।