অথবা, বাংলাদেশের আইনের শাসন পদ্ধতি বিশ্লেষণ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রিক নগররাষ্ট্র থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা পর্যন্ত ইতিহাসের এ সুদীর্ঘকালে কখনো গণতন্ত্রের বিজয় সূচিত হয়েছে, আবার কখনো মধ্যযুগীয় রাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে বিসর্জনও দেয়া হয়েছে। ইতিহাসের চড়াইউতরাই পথ অতিক্রম করেই গণতন্ত্র আজকের এ পরিপূর্ণ রূপ লাভ করেছে। গণতন্ত্রের সফলতায় আইনের শাসন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা ছাড়া গণতন্ত্রের ভিত্তিকে কোনক্রমেই মজবুত করা যাবে না। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে আইনের শাসন কায়েম করা অন্যতম একটি পূর্বশর্ত।
আইনের শাসন: আইনের শাসন বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, যে ব্যবস্থা আইনের নির্দিষ্ট গণ্ডির ভিতর দিয়ে সুসম্পন্ন হবে, আইনের চোখে সবাই সমান, কারও মধ্যে কোন ভেদাভেদ পালা না। নারী-পুরুষ, ক্ষমতাবান, ক্ষমতাহীন, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য একই আইন প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ আইনের এবাহ থাকবে সবার জন্য সমান।
আইনের শাসন বলতে Jennings বলেছেন, “প্রকৃত অর্থে আইনের শাসন বলতে বুঝায় একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা তথা সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থাকে, যে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা শুধু অনুমোদিত নয়, বরং একটি উত্তম গুণ, রাজনীতি শুধু গ্রহণযোগ্য নয়, বরং উৎসাহিত করা হয়। সেখানে এ বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে যেখানে আইনের শাসনের বৈশিষ্ট্য আপনি নির্গত হয়।
A.V. Diecy আইনের শাসনের তিনটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যথা:
ক. স্বৈরীক্ষমতার অনুপস্থিতি, খ. আইনের চোখে সমতা এবং গ. নাগরিক অধিকার।
বাংলাদেশের আইনের শাসনের প্রকৃতি: আমাদের সংবিধানের ৪২ (১) অনুচ্ছেদে আইনের শাসনের স্বীকৃতি দিয়ে বলা হয়েছে আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধসহ সব ধরনের শাসন সংক্রান্ত কার্যাবলি ও বাধ্যবাধকতার অধীনে প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের বাস করতে হবে। সুতরাং আইনের শাসন বলতে আমরা বুঝি প্রচলিত সব আইনের অধীনে অবশ্যই একটি দেশের সকল নাগরিকের সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। আইনের শাসন নিশ্চিত করার প্রধান উপাদান হচ্ছে সরকার কর্তৃক আইনের সঠিক মূল্যায়ন। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে বার বার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রদানের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত কোন সরকারই সে দাবি বাস্তবায়ন করেন নি।’
আইন প্রণেতাগণ আইন প্রণয়ন করেন, আবার উক্ত আইন তারাই লঙ্ঘন করেন। স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা আমাদের দেশে এ ধরনের চিত্র দেখতে পাই। যে দল যে সময় ক্ষমতায় গিয়েছে, সে দলই আইনকে নিজেদের ক্ষমতার হাতিয়ার বানিয়েছে। ‘৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন, বিএনপির শাসনামলে সন্ত্রাস দমন আইন, আওয়ামী লীগের সরকারের সময়ে জননিরাপত্তা আইন, এসবই সরকারি দল প্রণয়ন করেছে শুধু নিজেদের স্বার্থে এবং দুঃশাসনকে নিষ্কণ্টক করার জন্য, যদিও প্রত্যেকটি আইনের বিরুদ্ধে বিরোধী দল জনমত গড়ে তুলেছে এবং আইনগুলো বাতিলের প্রস্তাব তুলেছে। উদাহরণগুলো থেকেই আমাদের দেশের আইনের শাসনের দৈন্যভাব প্রকট হয়ে উঠে।
নিম্নে কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হলো, যার মাধ্যমে আমরা সহজেই আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপারে অনুমান করতে পারি।
পুলিশের হিসেবে দেশের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি প্রতিদিন গড়ে ৯ জন খুন এবং ১২ জন ধর্ষণের শিকার। গড়ে প্রতিদিন মোট অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে ৩শ টি। বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা আরও বেশি। বিগত ২০০০ সালের আগস্ট মাসে সারাদেশে ৯,৪৭৩টি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে ৮৯০টি, আগস্ট মাসে জননিরাপত্তা আইনে মামলা ১৭৯টি, সেপ্টেম্বরে ১৭২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আমাদের দেশে আইনের শাসনের অনুপস্থিতিতে ফতোয়াবাজি একটি মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। ১ জানুয়ারি ২০০১ সালে হাইকোর্টের এক ঐতিহাসিক রায়ে ফতোয়া নিষিদ্ধ করা হলেও এখনো এর প্রকোপ থেকে অনেকে রেহাই পাচ্ছে না।
উপসংহার: উপর্যুক্ত তথ্যাবলি হতেই আমরা আমাদের দেশে আইনের শাসনের মারাত্মক অবনতিশীল পরিস্থিতির চিত্র অবলোকন করতে পারি। অনেকের মতে, বাংলাদেশে আইন আছে কাগজে কলমে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই। তবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে নিরপেক্ষভাবে আইন প্রয়োগের বিকল্প নেই।