অথবা, বাংলাদেশের প্রবীণ হিতৈষী সংঘের কর্মসূচিসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের প্রবীণ হিতৈষী সংঘের কার্যক্রমের বিবরণ দাও।
উত্তর: ভূমিকা: মানুষ এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠে। কালের পরিক্রমার এক সময় বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়। তখন তাকে প্রবীণ বলে। বাংলাদেশে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা ও শিক্ষাদীক্ষার উন্নয়নের হেতু গড় আয় যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে প্রতিদিনই প্রবীণ নর-নারীর সংখ্যা বাড়ছে। এদেশের ৬০ বছরের উর্ধ্বে নর-নারীদের প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এসব প্রবীণদের খাদ্য, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধার অপ্রতুলতা প্রায় অনুভূত হয়। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সৃষ্টি হয়েছে। যা তার কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সমস্ত প্রবীণদের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপনে সক্ষম করে তুলেছে।
বাংলাদেশের প্রবীণ হিতৈষী সংঘের কার্যক্রম নিম্নে আলোচিত হলোঃ
১. বহির্বিভাগ চিকিৎসা সেবা: প্রবীণ হিতৈষী সংঘের আওতায় মাত্র ৫ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি গ্রহণের মাধ্যমে প্রবীণ রোগীদের নাক, কান, গলা, চক্ষু, দন্ত বিভাগের মাধ্যমে বিশেষ চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এতে অত্যন্ত কম খরচে বিভিন্ন রোগ নির্ণয় ও যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটি ব্যতীত প্রতিদিন সকাল ৮.০০ হতে ২.০০ পর্যন্ত বহির্বিভাগে অসংখ্যা রোগীকে দেখা হয়। তাছাড়াও স্বল্প খরচে সার্জারিও করা হয়।
২. আন্তঃবিভাগ চিকিৎসা সেবা: প্রবীণদের সার্জারিমূলক রোগের চিকিৎসা সেবা দিতে প্রবীণ হিতৈষী সংঘের নিজস্ব হসপিটাল রয়েছে। তাতে অভিজ্ঞ ডাক্তার ও নার্স সার্বক্ষণিক সেবা প্রদান করে থাকে। এতে সাধারণ বেডের জন্য প্রতিদিন ৭০০ টাকা এর কেবিনের ক্ষেত্রে ২০০ টাকা প্রদান করতে হয়। এমনকি রোগীদের আনা নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত এ্যাম্বুলেন্সেরও ব্যবস্থা করে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে প্রবীণদের স্বাস্থ্য উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
৩. বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণ: বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের গুরুত্বপূর্ণ এক কার্যক্রম বলে বিবেচিত হয়। দেশের গরিব ও অসহায় রোগীদের সমস্ত চিকিৎসা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে প্রয়োজনীয় ঔষধ বিনামূল্যে সরবরাহ করে থাকে। ফলে ৩০ শতাংশ গরিব রোগী এ সুবিধা পেতে সক্ষম হয়ে উঠে।
৪. আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ড: প্রবীণদের আয়ের কোন উৎস থাকে না বলে তারা তাদের অতি প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ এসব প্রবীণদের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের ২৬টি শাখার মাধ্যমে আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডের সূচনা করেছে। এতে করে প্রবীণরা হাঁস-মুরগি পালন, শাক-সবজি চাষ, গরু-ছাগল পালনের মাধ্যমে কিছু আয় করতে পারছে।
৫. জ্ঞান বৃদ্ধিকরণঃ মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রবীণ হিতৈষী সংঘে আসছে। তারা প্রবীণদের সম্পর্কে জানছে, তাদেরকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে। আর এ কাজে সংঘের কর্মকর্তা সাহায্যদান করে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াচ্ছে।
৬. প্রবীণদের স্বাস্থ্য পরিচর্যা বিষয়ক প্রশিক্ষণঃ WHO এর অর্থায়নে ১৯৮৮ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈনী সংঘ জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও সামাজিক আয়োজন করছে। বাংলাদেশের প্রবীণদের স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ ও সচেতনতা বৃদ্ধিই এ কার্যক্রমের লক্ষ্য। ফলশ্রুতিতে দেশে অনেক প্রশিক্ষকের সৃষ্টি হয়েছে।
৭. পাঠাগার কার্যক্রম: প্রবীণদের অনেকে বই-পত্রপত্রিকা পড়তে ভালবাসে। তাই প্রবীণ হিতৈষী সংঘে ২০০ টাকার বিনিময়ে নির্মিত পাঠাগারের সদস্যপদ লাভের সুযোগ রয়েছে। এতে করে প্রবীণরা বেশ ভালো সময় কাটাতে সক্ষম হয়।
৮. পত্রিকা প্রকাশ: বাংলাদেশের প্রবীণদের সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের পক্ষ থেকে প্রতিবছর ‘প্রবীণ হিতৈষী পত্রিকা’ প্রকাশ করা হয়। এতে প্রবীণদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, আলাপ আলোচনা ও জ্ঞানগর্ত উক্তির সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন ঘটানো হয়।
৯. চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা: প্রবীণদের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা হেতু প্রতিটি কেন্দ্রেই টেলিভিশনের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া মাঝে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গজল, ধর্মীয় আলাপ আলোচনার ব্যবস্থা করে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ।
১০. আন্তর্জাতিক কার্যক্রমঃ বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এটি International Federation on Aging এর পূর্ণ সদসা। এর যাবতীয় নির্দেশাবলি বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ মেনে চলে। এমনকি এটি Astrilia Association of Ferontology Help Age International এর সাথেও নানা সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে।
১১. প্রশিক্ষণদানঃ বিশ্বব্যাংক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ প্রশিক্ষণদান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। প্রবীণদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সক্ষম করে তোলাই এর মূল লক্ষ্য। ফলে দেশে প্রবীণদের কল্যাণ সাধন আরো বেগবান করা সম্ভবপর হয়েছে।
১২. অনুদান সংগ্রহঃ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে অর্থ, অনুদান ও সাহায্য সংগ্রহ করাও এই সংঘের অন্যতম কাজ বলে প্রতিভাত হয়ে উঠে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ একটি স্বেচ্ছাসেবী ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। তাই সংঘ তার সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থের বিভিন্ন অনুদান সংগ্রহে ব্যাস্ত থাকে। আর তা সম্পন্ন করতে কিছু কর্মকর্তাও প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে।
১৩. প্রবীণ নিবাস পরিচালনাঃ নিঃস্ব ও আশ্রয়হীন প্রবীণদের জন্য প্রবীণ হিতৈষী সংঘের আওতায় প্রবীণ নিবাস পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রবীণ নিবাসে প্রবীণদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, ধর্মীয় কার্যাবলি সুসম্পন্ন করার ব্যবস্থাসহ লাইব্রেরিতে পড়া ও খেলাধুলার সুযোগ ও দান করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে এ দেশের অসংখ্য প্রবীণ বেঁচে থাকার জন্য। শেষ আশ্রয় হিসেবে এই নিবাসের সুবিধা পাচ্ছে।
১৪. প্রবীণ সেবা পুরস্কারের ব্যবস্থাঃ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের প্রবীণ সেবা পুরস্কারের প্রদান এক মহতী উদ্যোগ। যেসব ব্যক্তি তার আপন পিতামাতা, শ্বশুর-শাশুড়ি ও নিকট আত্মীয় স্বজনসহ যে-কোনো প্রবীণের সুন্দরভাবে সেবা শুক্রযা প্রদান করেছে। সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে তাদের নির্বাচন করে এ পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এতে সকলে প্রবীণদের সেবাদানে উৎসাহিত হয়ে উঠে।
১৫. আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালনঃ প্রবীণদের সুযোগ- সুবিধা বৃদ্ধি ও প্রবীণ সেবার উন্নয়ন ঘটাতে প্রতিবছরের ১ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের অধীনে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালিত হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ প্রবীণদের কল্যাণার্থে পরিচালিত হচ্ছে আর বাস্তবায়ন করছে বিভিন্ন কার্যক্রম। দেশের লাখ লাখ প্রবীণদের জীবন অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে দিতেই এর যাত্রা। তাই জাতীয় জীবনে প্রবীণ হিতৈষী সংঘের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি বলে গণ্য হয়।