বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা তুলে ধর।

উত্তরঃ ভূমিকা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীদের অবদান ছিল অপরিমেয়। নারীরা এগিয়ে এসেছিল মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। তারা এদেশের মুক্তিবাহিনীদেরকে তাদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছিল নিজেদের ছেলে বলে পরিচয় দিয়ে। নারীদের উপর ঐ পাকিস্তানি জানোয়ারেরা চালিয়েছিল পৈশাচিক নির্যাতন, বাংলার মা ও বোনের ইজ্জত ও সম্মানকে কেড়ে নিয়েছিল পাকিস্তানি হায়েনারা। প্রকৃতপক্ষে ঐসকল মা ও বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল। নিচে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান তুলে ধরা হলো:

১. অস্ত্র হাতে নারী: যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এগিয়ে এসেছিল। দেখা যায় কোনো কোনো জায়গায় নারীরা পুরুষের পাশাপাশি অস্ত্র হাতে নিয়ে পাকবাহিনীর সাথে লড়াই করেছিল এবং ফলশ্রুতিতে তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তারা এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছিল। এভাবে তারা মৃত্যুকে পরোয়া করেনি দেশের জন্য।

২. সংগ্রামে নারী: একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার নারীরা ঘর থেকে বের হয়েছিল। তারা পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেছিল। বিভিন্ন ধরনের সমাবেশ, মিছিল মিটিং ও সেমিনারের আয়োজন করেছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের গান ও নাটক রচনা করেছিল।

৩. দেশের জন্য সন্তান উৎসর্গ: নিজের গর্ভের সন্তান নারীর কাছে অমূল্য ধন। সেই অমূল্য ধনকে দেশের জন্য উৎসর্গ করতে বাংলার নারীসমাজ এতটুকু পিছপা হয়নি। মা তার সন্তানের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সন্তানের মায়ার চেয়ে দেশকে বড় করে দেখেছেন বাংলার নারীসমাজ।

৪. স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে নারীদের অবদান : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী জনগণের অন্যতম প্রেরণার উৎস ছিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে আস্থা অর্জন করেছিল এবং এর সাথে সংশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ শব্দ সৈনিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ২৬ মার্চ সকাল ৭.৩০ মিনিট চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্রের কর্মিগণ বেতারকেন্দ্রটিকে স্বাধীন বাংলা বিপবী বেতারকেন্দ্র হিসেবে নামকরণ করেন এবং নব উদ্যমে কার্যক্রম শুরু করেন। বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এই কেন্দ্রে অংশগ্রহণকারী শিল্পী ছিলেন ইংরেজি সংবাদ পাঠিকা পারভীন হোসেন, লেখিকা ও পাঠিকা বেগম মুশতারী শাফী, সংবাদ নাসরিন আহমেদ শিলু, বদরুন্নেছা আহমেদ, আইভি, রহমান ও মেহের খন্দকার।

৫. দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ: বাংলার নারীসমাজ দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ পর্যন্ত করেছে। দুই লক্ষ নারী তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। অনেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন।

৬. গণবাহিনী ও গেরিলা যুদ্ধ: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি গণবাহিনী ও গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়ে সরাসরি রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়ে অবদান রাখতে সক্ষম হয়। নারীরা বিভিন্ন সেক্টরের অধীনে সরাসরি রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে গেরিলা পদ্ধতিতে শত্রুসেনাদের গাড়িতে, গানবোটে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন।

৭. মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহযোগিতা: যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্নাবান্না, খাদ্য সংগ্রহ ও সরবরাহকারিণী হিসেবে নারীর ভূমিকা ছিল উলেখযোগ্য। মুক্তিযোদ্ধারা যখন দেশের অভ্যন্তরে শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন তখন তাদের খাদ্য যোগানের তেমন ব্যবস্থা না থাকায় এ সময় গ্রামগঞ্জের অনেক পরিবার তাদের খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন। এক্ষেত্রে নারীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আহারের ব্যবস্থা করতেন। অনেককে এজন্য জীবনও দিতে হয়েছে। নারীর এ মহান ত্যাগ ও আত্মদানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত হয়।

৮. মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রূযা: যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরবিক্রমে লড়তে গিয়ে আহত হন। এসব আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রূযার জন্য দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরে হাসপাতাল ও ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়। এছাড়াও ক্যাম্পে ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়। এসব চিকিৎসাকেন্দ্রে নারীরাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছিল।

৯. খবরাখবর সংগ্রহ: যুদ্ধকালীন সময়ে পাকসেনাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পরাজিত করার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাকসেনাদের অবস্থানের খবর, গোপন আস্তানার খবর, তাদের পরিকল্পনা, ঘাঁটির অস্ত্রশস্ত্র, সৈং সংখ্যা ইত্যাদি তথ্য জানা প্রয়োজন ছিল। এক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি গ্রামগঞ্জের নারীরাও পাকবাহিনী ও রাজাকারদের দৃষ্টি এড়িয়ে খবরাখরব সংগ্রহের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল।

১০. যুদ্ধে অনুপ্রেরণা দান: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকবাহিনী কর্তৃক বাঙালি জনগণের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার প্রত্যক্ষ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এদেশের অনেক মা তার একমাত্র অবলম্বন উপযুক্ত ছেলেকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন। এমনিভাবে বোন তার ভাই, স্ত্রী তার স্বামীকে অনুপ্রাণিত করেন।

১১. বহির্বিশ্বে প্রচারণা: যুদ্ধকালীন সময়ে পাকবাহিনী কর্তৃক এদেশের জনগণের উপর যে নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো হয়েছিল তার বাস্তব চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা আদায়ের লক্ষ্যে দেশে-বিদেশে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে অনেক নারী এবং বিভিন্ন মহিলা সংগঠন কাজ করেছিল।

১২. প্রচারমাধ্যম: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রচারমাধ্যমগুলোর অবদান অপরিসীম। এক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এ বেতারকেন্দ্রের বিভিন্ন বিভাগে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উলেখযোগ্য। তারা নাটকের মাধ্যমে পাকসেনাদের হতাশা ও পরাজয়ের চিত্র তুলে ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনাকে জাগিয়ে তোলে।

১৩. নির্যাতন ভোগ: মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এদেশের নিরীহ বাঙালি নারীদের পাকবাহিনী কর্তৃক বর্বরোচিতভাবে ধর্ষিতা ও নির্যাতিতা হওয়া দেখে সর্বস্তরের জনগণ পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদরদের প্রতি ঘৃণা ও প্রতিহিংসায় জ্বলে ওঠে। অতঃপর পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণ সংগঠিত হয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, তুলনামূলক হারে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান পুরুষের অবদানের তুলনায় কোনো অংশেই কম ছিল না। যদিও দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই যে, দীর্ঘদিন যাবৎ ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে কেবল নারীকে নির্যাতিতা রমণী হিসেবেই দেখা হয়েছে। মূলত মুক্তিযুদ্ধে নারী কেবল নির্যাতিত হয়নি বরং তারা মুক্তিযুদ্ধে সহযোগী শক্তিও ছিল।