বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণযুদ্ধের গুরুত্ব আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের অবদান আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র, নারী ও সাধারণ মানুষের ভূমিকা আলোচনা কর। উত্তর।

ভূমিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের গণমানুষের মুক্তির সংগ্রাম। সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল এ যুদ্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রজনতা, নারী, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, বাঙালি সৈন্য, পুলিশ, ইপিআর, আনসার সদস্যসহ সকল পেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠে গণযুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধে গণযুদ্ধের গুরুত্ব: ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের জনতা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর যার যা কিছু আছে তা নিয়ে জনতা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিচে মুক্তিযুদ্ধে গণযুদ্ধের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:

১. মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের অবদান: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ত্যাগ ও তিতিক্ষা ছিল অনন্য। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা কর্মসূচি এবং ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলা এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সর্বশেষ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অপরিহার্য ছিল। যখনি রাজনৈতিক নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তখনই ছাত্রসমাজ দুর্বার আন্দোলন শুরু করেছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ছাত্রলীগ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাপ এবং তাদের ছাত্র সংগঠন শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ছাত্র সংগঠনগুলো ভারতে স্থাপিত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবির থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর অধিকাংশ ছিল ছাত্র। এছাড়া গেরিলা বাহিনীরও বেশিরভাগ সদস্য ছিল ছাত্র। ছাত্রসমাজ মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা, চিকিৎসাসেবা প্রভৃতিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। পাকিস্তান সরকারের বৈষম্য ও দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ও অবদান ছিল গৌরবোজ্জ্বল। কাজেই মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের সংগ্রাম ও ত্যাগ যুদ্ধের সাফল্য অর্জন ও স্বাধীনতা অর্জনে অপরিহার্য ছিল।

২. মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদান: মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যদি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করত তাহলে বাংলাদেশর মুক্তিযুদ্ধে সফলতা অর্জন সম্ভব হতো না। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে সকলকে আহ্বান জানান, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। ৭ মার্চ ভাষণের পর সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে সর্বপ্রথম জনতা সেনাবাহিনীর প্রবেশ প্রতিরোধ করে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ভারী অস্ত্রের বিপরীতে জনতা লাঠি, তীর, ধনুক, বন্দুক নিয়ে প্রতিরোধ করে। এদের বেশিরভাগ সদস্য ছিল সাধারণ জনতা, অল্প শিক্ষিত কৃষক শ্রেণি। বাংলার কৃষক লাঙল ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে গেছে, কৃষক শ্রমিকরা কারখানার কাজ ফেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল হতো না।

৩. মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান ছিল অপরিহার্য। মুক্তিযুদ্ধে যে সকল সংগ্রামী
কমিটি গঠিত হতো সেখানে নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকত। মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সাথে সাথে গেরিলা যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করত নারীরা। মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অস্ত্রচালনা ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান করত। মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রুষা প্রদান, আশ্রয় দান ও মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য প্রদান করত। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ছিলেন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধে এদেশের লক্ষ লক্ষ নারী পাকসেনা ও দেশীয় আল-বদর, আল-শামস্ ও রাজাকার বাহিনী দ্বারা ধর্ষিত ও নির্যাতিত হয়েছিল। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে নারীরা। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষণী, তারামন বিবি, ডাঃ সেতারা বেগমসহ অগণিত নারীর অবদান ও ত্যাগ জাতি শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করে।

৪. পেশাজীবীদের অংশগ্রহণ: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পেশাজীবীদের ভূমিকা অসামান্য। কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী ও সাহিত্যিক নিয়মিত মুক্তিবাহিনীকে উৎসাহ ও উদ্দীপনা প্রদান করত।

৫. রাজনৈতিক দলের অবদান: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছিল অপরিহার্য। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দ্বারাই মুক্তিযুদ্ধে গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হয় এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুজিবনগর সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনৈতিক দল হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ব বাংলার দাবি ও অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপসহীন নেতৃত্ব আওয়ামী লীগকে পূর্ব বাংলার সর্বাধিক জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এরপর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা হলে রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার জন্য সকল শক্তি, মেধা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগসহ ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফ্ফর), কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় কংগ্রেস ইত্যাদি দল সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি, প্রবাসী সরকার গঠন, পরিচালনা, প্রশিক্ষণ শিবির প্রতিষ্ঠা, প্রশিক্ষণ প্রদান, শরণার্থীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা, বহির্বিশ্বে বিশ্ব জনমত গঠনের নেতৃত্ব প্রদানসহ সার্বিক দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ভূমিকা রাখে।

৬. সাংস্কৃতিক কর্মীদের অবদান: মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যম, ব্যক্তি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের অবদান অবিস্মরণীয়। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার খবর প্রচার করে সাংবাদিকগণ স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী, সাহিত্যিকদের সংবাদ, দেশাত্মবোধক গান, রণাঙ্গনের খবর, গণসংগীত, মুক্তিবাহিনীর সাফল্য প্রভৃতি প্রচার করে মুক্তিবাহিনীকে সর্বদা অনুপ্রেরণা যোগাতো।

৭. উপজাতিদের অবদান : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উপজাতিদের অবদান উল্লেখযোগ্য। গারো, সাঁওতাল, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি উপজাতি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ তীর ধনুককে পুঁজি করে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ চালায় সাঁওতালরা। ইউকে চিং মারমা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত হয়।

৮. সকল ধর্মাবলম্বীর অংশগ্রহণ: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সকল ধর্ম ও বর্ণের লোক অংশগ্রহণ করে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব বাংলার জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে নারী পুরুষ, কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক, শিশু, কিশোর, শিল্পী, সাহিত্যিক সকলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরে সকল শ্রেণির লোক অংশগ্রহণ করে বলে একে গণযুদ্ধ বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধে গণযুদ্ধের অবদানের ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়।