অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা আলোচনা কর।
উত্তর। ভূমিকা: বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটিকে যেভাবেই বিশেষায়িত করা হোক না কেন তাতে স্বল্পতা থেকে যায়। ১৯৪৭ সালে ‘ভারত স্বাধীনতা আইন’ অনুযায়ী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলানা হয়ে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ও সামরিক অফিসারেরা সঠিক শাসনতন্ত্রের দিকে অগ্রসর না হয়ে বাঙালিদের উপর শুরু করে পূর্বের চেয়ে ভয়ংকর অপশাসন ও শোষণ। এরই প্রেক্ষিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির জন্য ক্যারিশমাটিক সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়ে আত্মত্যাগী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। মুসলিম লীগের পতাকাতলে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হলেও সাম্প্রদায়িকতার কারণে তিনি বাংলার অন্যান্য উদার নেতাদের সাথে মুসলিম লীগ থেকে বেড়িয়ে এসে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। যা তাকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা এনে দিয়েছিল। তবে তিনি অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করে আগরতলা মামলার আসামি হয়ে জেলে থাকার সময়। ১৯৬৯ সালে মণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হন। এরপর ৭০ এর নির্বাচনে তার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ নিরভুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহনা করলে বঙ্গবন্ধু বাঙালির দাবিকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত করেন। তাঁরই বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাঙালি পাকিস্তানি দানবদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। এই মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান অপরিসীম।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান সম্পর্কে নিচে আলোচনা
করা হলো:
১. ১৯৬৬ সালের ‘৬ দফা দাবি’ ও আগরতলা মামলা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা দাবি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ প্রেক্ষাপট। সামরিক অপশাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো ১৯৬৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক সম্মেলনে বসলে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি এবং স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি সংবলিত ‘ছয় দফা’ কর্মসূচি উত্থাপন করেন। তাঁর এই ‘হয়ফা কর্মসূচি’ সম্মেলনে গৃহীত হয়নি। কিন্তু তিনি দমে যাননি। বাঙালির মুক্তির বিষয়ে তিনি ছিলেন আপসহীন। তিনি তাঁর অত্যন্ত সুন্দর সাংগঠনিক দক্ষতার বলে বাঙালিদের সামনে তাঁর ছয়দফা দাবি তুলে ধরেন। ফলে বাঙালিরা বুঝতে পারে যে, এই ‘ছয়দফা দাবি’ পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাত থেকে তাদের মুক্তি সনদ বা ‘ম্যাগনাকার্টা’। এই দাবি আদায়ের জন্য বাঙালিরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে।
এ অবস্থায় পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান দিশেহারা হয়ে আগরতলা মামলার আশ্রয় নেয়। ‘ছয়দফা’ দাবির বিপরীতে পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন অভিযোগ তুলে যে, পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ভারতের আগরতলায় ষড়যন্ত্র করছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুরকে প্রধান করে ৩৫ জন নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে গ্রেফতার করলে বাঙালি জনগণও তাদের অধিকারের বিষয়ে আরো বেশি সোচ্চার হয়ে উঠে।
২. উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহার: ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ‘আগরতলা মামলা’ নামক মিথ্যা মামলা দায়ের করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে গ্রেফতার করলে বাঙালি জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে এই বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করে এবং ১৯৬৯ সালে তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এই পরিষদ ৬ দফার সাথে আরো ৫ দফা যোগ করে ১১ দফা দাবি ঘোষণা করে আন্দোলনকে আরো জোরদার করে তোলে। এই ১১ দফার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল মিথ্যা মামলায় আটককৃত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি।
সামরিক সরকার গণঅভ্যুত্থানে বিক্ষোভকারীদের উপর ব্যাপক দমনপীড়ন চালায়। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসেই ৫৭ জন নিহত হন এবং আহত হয় অনেকে। গ্রেফতার করা হয় ৪,৭১০ জনকে। কিন্তু বাঙালি দমে যায়নি, হরতাল ও ধর্মঘটের মতো বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানকে আরো জোরালো করে তোলে। জানুয়ারি মাসকে ছাপিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহরুল হক এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যা করা হলে গণঅভ্যুত্থান অগ্নিরূপ ধারণ করে যা আইয়ুব খানের পতনকে অনিবার্য করে তোলে। এরই প্রেক্ষিতে ২১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পাকিস্তানের
রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেন। ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দি মুক্তি পান। শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শে ২৩ ফেব্রুয়ারি বর্তমান সোহরাওয়াদী উদ্যানে আওয়ামী লীগের এক সম্মেলন হয় এবং উক্ত সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এই সম্মেলনে পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
৩. সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়: ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ১৯৬৯ সালের ২৬ মার্চ এক বেতার ভাষণে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা দেন। এরই। প্রেক্ষাপটে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের অধিকাংশ আসনে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জাতীয় পরিষদের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। ৭টি সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৭টি। সর্বমোট আসন ছিল ৩১৩টি। প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করে। ফলে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে ক্রমশ জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে পরিণত করেন।
৪. অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায় : নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা ১ মার্চ স্থগিত ঘোষণা করে। ফলে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ছাত্রসমাজ, শ্রমিক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঐদিনই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ডাকসুর সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিলে এক বৈঠকে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। এই পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সমাবেশ করে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। পরে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের এক বিক্ষোভসমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথির ভাষণ দেন। এই বিক্ষোভ সমাবেশে ৪ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন অর্থবেলা হরতাল পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই সমাবেশে ছাত্রলীগ ৫ দফাভিত্তিক প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করে যা ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ নামে চিহ্নিত। দেশের সর্বস্তরের আপামর জনতা ছাত্র সমাজের ইশতেহারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে। এরকম পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ৬ মার্চ এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণা নির্যাতিত বাঙালিদের আশ্বস্ত করতে পারেনি। ফলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৭ মার্চ বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণার জন্য এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। এই জনসভায় অসহযোগ আন্দোলনকে আরো তীব্র করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সম্ভাব্যতাকে আরো সামনে এগিয়ে আনা হয়।
৫. বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ: পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ৭ মার্চ বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাঙালি জনতার ঢল নামে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য। অন্যদিকে, পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হায়েনার দৃষ্টিতে ৭ মার্চের জনসভার উপর তীক্ষ্ণ নজর রানে। ফলে বঙ্গবন্ধু সম্ভাব্য, হত্যাকাণ্ড এড়াতে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। তিনি ৭ মার্চের ভাষণে কৌশলে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন এবং অসহযোগ আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপদান করেন। ৭ মার্চের জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন- “আমার অনুরোধ, প্রত্যেক মহল্লায়, ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। মনে রাখবেন রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার পাশাপাশি তা কার্যকর করার জন্য সকল প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন এবং খাজনা না দেওয়ার জন্যও আহ্বান জানান। এছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের কর্মস্থলে না যাওয়া এবং বেতারে অসহযোগ আন্দোলনের খবর সম্প্রচার না করলে বাঙালি কর্মকর্তাদের কাজ না করার নির্দেশ দেন। ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে। ঐ দিনই ছাত্ররা ঢাকার রাজপথে রাইফেল নিয়ে প্রদক্ষিণ শুরু করে দেয়। ৮ মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়।
৬. ২৫ মার্চের গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা: পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন এবং আওয়ামী লীগের সাথে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনার প্রস্তাব দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলোচনায় বসতে রাজি হলেও কিন্তু অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেননি। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত কৌশলে বাঙালি সৈন্যদের অস্ত্র জমা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। ১৯ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুরে বাঙালি
সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। ২২ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টো আলোচনায় যোগ দিলেও তা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। ফলে ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরস্ত্র ও নিরীহ বাঙালিদের উপর ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ইয়াহিয়া খানের চালাকি বুঝতে পারেন এবং ঐ দিনই তারা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করলে বঙ্গবন্ধু তাদের পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। ঐদিন যে কোনো নির্দেশনা প্রচার করার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিগর এনে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে একটি ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয় যাতে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে নির্দেশনা প্রচার করা যায়।
পূর্ব নির্দেশনা অনুযায়ী ২৫ মার্চ রাত ১১.৩০ টায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরস্ত্র, নিরীহ বাঙালিদেরকে গণহত্যা শুরু করে। ঢাকা শহরে গণহত্যার দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফারমান আলী। প্রথম আক্রমণ করা হয় ফার্মগেইট এলাকায় মুক্তিকামী জনতার উপর। এরপর সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ ও বর্তমান জহুরুল হক হলে। রোকেয়া হলেও চলে পাশবিক হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন। এই হত্যাকাণ্ড পুরো ঢাকা শহরসহ সারা দেশে চলে। রাত ১.৩০ টায় বঙ্গবন্ধুকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু এর অল্পকিছুকাল আগেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন যা ২৬শে মার্চ দিনের বেলায়, ইপিআর ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌছে দেওয়া হয়। স্বাধীনতা বাণীটি ছিল ইংরেজিতে। এর বাংলা ছিল এরকম “এটাই হয়তো আমার শেষবার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত দেশবাসীকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।” (হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র থেকে।)
পরে ২৬ মার্চ ও ২৭ মার্চ এম. এ. হান্নান ও মেজর জিয়াউর রহমান নিজেদের মতো করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন।
৭. স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও সশস্ত্র গণপ্রতিরোধ: স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ আত্মগোপনে চলে যান এবং ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার অম্রেকাননে মিলিত হয়ে সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করে। এই সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। এরপর ১৭ এপ্রিল ৪৫ জন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সরকার শপথ গ্রহণ করেন। শপথ বাক্য পাঠ করান অধ্যাপক ইউসুফ আলী। এ সময় ১২৭ জন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকসহ কিছু গণমাধ্যম ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামানুসারে এই সরকার ‘মুজিবনগর সরকার’ নামে পরিচিতি পায়। এই সরকারের রাষ্ট্রপতি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কিন্তু পাকিস্তান কারাগারে বন্দি থাকায় উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন। পদাধিকার বলে তিনি সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ।
মুজিবনগর সরকার অভ্যন্তরীণ প্রশাসন ও মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য ১২টি মন্ত্রণালয় গঠন করে। এই মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, যার প্রধান ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। এই মন্ত্রণালয় মুক্তিবাহিনীকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সমগ্র দেশকে এগারোটি সেক্টরে বিভক্ত করে এবং মুক্তিযুদ্ধকে সশস্ত্র গণপ্রতিরোধে পরিণত করে। এছাড়াও মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বহির্বিশ্বে বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনও প্রেরণ করে।
৮. পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পতন ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় : পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন ছায়ার মতো এক অকৃত্রিম অনুপ্রেরণা। প্রিয় নেতা পাকিস্তান কারাগারে বন্দি এই বিষয়টি বাংলাদেশের মুক্তিকামী সশস্ত্র গণমানুষকে রণাঙ্গনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাড়তি মনোবল দিয়েছিল। তাই তো ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়েও পাকিস্ত ানি সৈন্যরা বাঙালির সামনে টিকতে পারেনি। একের পর এক বিভিন্ন জায়গায় তারা পরাজিত হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ কমান্ড গঠন করলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পরাজয় অত্যাসন্ন হয়ে। পড়ে। পর্যায়ক্রমে ১৬ই ডিসেম্বর এসে ঢাকার পতন ঘটলে পাকহানাদার বাহিনী যৌথ কমান্ডের কাছে চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করে নিতে বাধ্য হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজি যৌথ বাহিনীর প্রধান লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর মধ্যে দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অনন্য নাম। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে অবদান রেখে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের জন্য তিনি জাতির পিতা হিসেবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ধাপে ধাপে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দান করে তিনি চলে আসেন নেতৃত্বের শীর্ষ স্থানে। একটি নতুন রাষ্ট্রের জনক হিসেবে তাঁকে ভূষিত করা হয়েছে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির অভিধায়।’