বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থীদের ভূমিকা আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থীদের অবস্থা উল্লেখ কর।

উত্তর। ভূমিকা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শরণার্থীদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে সকল ক্ষেত্র জনজীবন ভয়াবহ বিপর্যয়ের শিকার হয়। জনজীবন স্বাভাবিক না থাকায় অনেক লোক প্রাণভয়ে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে। এদেশীয় রাজাকার, আল-শামস্, আল-বদর, শান্তি কমিটি এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে আত্মরক্ষার জন্য নিজ বসতি ও গ্রাম ছেড়ে সহায়সম্বলহীন হয়ে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে। সব মিলিয়ে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে ন্যূনতম এক কোটি থেকে দেড় কোটি লোক শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।

স্বাধীনতা যুদ্ধে শরণার্থীদের ভূমিকা: শরণার্থীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। নিচে স্বাধীনতা যুদ্ধে শরণার্থীদের ভূমিকা উল্লেখ করা হলো:

১. স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণ: বাংলাদেশ থেকে জাতি, বর্ণ, ধর্ম, নির্বিশেষে প্রায় এক থেকে দেড় কোটি লোক শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ভারতে অর্থনৈতিক সমস্যার পাশাপাশি আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করে। শরণার্থী সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে ভারত সরকার মনে করে যে, এ সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো পাকিস্তানের পরাজয় ও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ করা। এজন্য ভারত সরকার দ্রুত পাকিস্তানের বিপক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করে। এ বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর সীমান্তবর্তী ভারতে অবস্থান ছিল যেমন অসম্ভব তেমনি ব্যয়বহুল। যার জন্য ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।

২. পাকিভাদের বিপক্ষে বিশ্ব জনমত গঠন: পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা যে স্বাভাবিক ছিল না তার প্রমাণ মিলে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর দেশত্যাগ। পাকিস্তানি বাহিনী ও এদেশীয় দোসররা যে গণহত্যা, অত্যাচার ও নির্যাতন চালায় তার ফলে প্রাণভয়ে নিজ দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তান বিশ্ব দরবারে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করায় এবং বিপুল পরিমাণ শরণার্থীদের আশ্রয় বিশ্ব জনমত পাকিস্তানের বিপক্ষে যায়। বিশ্ব জনমত স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায় অবস্থান গ্রহণ করে।

৩. মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি: ভারত শরণার্থী সমস্যাকে প্রধান ইস্যু করে বিশ্ব জনমত গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। লাখ লাখ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করার ফলে ভারত বিশ্ববাসীকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও ফধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এ সহায়সম্বলহীন আতঙ্কগ্রস্ত জনসাধারণ ভারতে আশ্রয় নিয়ে বহুবিধ সমস্যা সৃষ্টি করছে। ফলে বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়।

৪. প্রশিক্ষণ প্রদান ও মুক্তিযোদ্ধা তৈরি: ভারত সরকার শরণার্থীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। শরণার্থীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করে। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এবং বেসামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এ প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ভারতের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয় এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তারা নিযুক্ত হয়। এ সকল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধে দক্ষ হয়ে উঠে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রসমাজ শরণার্থীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি করেছিল।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, শরণার্থী সমস্যা চূড়ান্ত বিচারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সার্থক ও সফল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ভারত সরকার শরণার্থী সমস্যাকে প্রধান ইস্যু করে বিশ্ব জনমত গঠন করতে সমর্থ হয় এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় ত্বরান্বিত হয় এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় লাভ করে।