বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সামরিক সংগঠনের বিবরণ দাও।

অথবা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সামরিক সংগঠন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সামরিক প্রশাসনের বর্ণনা দাও।

অথবা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সামরিক প্রশাসন সম্পর্কে আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী পাক হানাদার বাহিনী যখন ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ ঘুমস্ত মানুষের উপর গণহত্যা চালায় তখন পূর্ব বাংলার মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ হত্যা প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে প্রতিটি জেলা শহরে ই. পি. আর, আনসার, ছাত্র, শ্রমিক ও বিভিন্ন সংগঠনের কর্মী এবং সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারীদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। এরপর পেশাদার সৈন্যদের নিয়ে নিয়মিত স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক ছিলেন অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সুষ্ঠু ও শৃঙ্খলভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে এবং প্রত্যেকটি সেক্টরকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। এছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরো কয়েকটি বাহিনী গড়ে উঠেছিল। যেমন- বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তম এর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সামরিক সংগঠনসমূহ : সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান এম. এ. জি ওসমানী সুষ্ঠুভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র যুদ্ধক্ষেত্রকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করেন। প্রতিটি সেক্টরের ভার একজন সেক্টর কমান্ডারের হাতে অর্পণ করা হয়। নিচে সেক্টর ও এর দায়িত্বরত কমান্ডারের বিবরণ দেওয়া হলো:

সেক্টর নং-১: চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ফেনীকে নিয়ে এক নম্বর সেক্টর গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের জুন মাস পর্যন্ত এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। এরপর এ সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন মেজর মোহাম্মদ রফিক।

সেক্টর নং-২: নোয়াখালী, আখাউড়া, ভৈরব রেললাইন পর্যন্ত কুমিল্লা জেলা, ঢাকা জেলার ঢাকা এবং ফরিদপুর জেলার কিছু অংশ নিয়ে ২নং সেক্টর গঠিত। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ এবং পরবর্তী সময়ের জন্য দায়িত্বে ছিলেন মেজর এটিএম হায়দার।

সেক্টর নং-৩: আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন থেকে পূর্বদিকে কুমিল্লা জেলা। সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা, ঢাকা জেলার কিছু অংশ এবং ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমা নিয়ে ৩নং সেক্টর গঠিত হয়। প্রথমে এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর কে. এম. শফিউল্লাহ এবং পরবর্তীতে মেজর এ. এন. এম. নুরুজ্জামান।

সেক্টর নং-৪: সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল, খোয়াই শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তরদিকে সিলেট ডাউকি সড়ক নিয়ে ৪নং সেক্টর গঠিত হয়। এ সেক্টরের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন মেজর সি. আর, দত্ত।

সেক্টর নং-৫: সিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চল, সিলেট ডাউকি সড়ক থেকে সুনামগঞ্জ-ময়মনসিংহ জেলার সীমান্ত অঞ্চল নিয়ে ৫নং সেক্টর গঠিত। এ সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী।

সেক্টর নং-৬: রংপুর জেলা ও দক্ষিণ দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও মহকুমাকে নিয়ে ৬নং সেক্টর গঠিত হয়। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন উইংকমান্ডার এম. কে বাশার।

সেক্টর নং-৭: দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল এবং রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা নিয়ে ৭নং সেক্টর গঠিত হয়। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর নাজমুল হক ও মেজর কাজী নুরুজ্জামান।

সেক্টর নং-৮: কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুরের অধিকাংশ অঞ্চল এবং খুলনা জেলার দৌলতপুর; সাতক্ষীরা সড়ক পর্যন্ত ৮নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এবং পরে এম. এ মঞ্জুরের উপর সেক্টরের দায়িত্ব ছিল।

সেক্টর নং-৯: দৌলতপুর, সাতক্ষীরা সড়ক থেকে খুলনা জেলার দক্ষিণাঞ্চল, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা নিয়ে ১নং সেক্টর গঠিত হয়। এ সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর এম, এ জলিল। ডিসেম্বরের চূড়ান্ত যুদ্ধের শেষ কয়দিন মেজর এম. এ. মঞ্জুর এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন।

সেক্টর নং-১০: নৌ কমান্ডো সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও অভ্যন্তরীণ নৌপথকে নিয়ে ১০নং সেক্টর গঠিত ছিল। ১০ নং সেক্টরে নিয়মিত সেক্টর কমান্ডার ছিল না। এ সেক্টরের দায়িত্ব ছিল নৌ কমান্ডাররা।

সেক্টর নং-১১: কিশোরগঞ্জ মহকুমা ময়মনসিংহ জেলা টাঙ্গাইল জেলাকে নিয়ে ১১নং সেক্টর গঠিত হয়। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর আবু তাহের। নভেম্বর মাসে তিনি গুরুতরভাবে আহত হলে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহ এখানকার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল।

নিয়মিত বাহিনী: সেক্টরগুলো ছাড়াও আরো কয়েকটি নিয়মিত বাহিনী ও তিনটি বিগ্রেড আকারের ফোর্স ছিল। যথা: ১. ‘জেড’ ফোর্স: ২. ‘কে’ ফোর্স এবং ৩. ‘এস’ ফোর্স। এ ফোর্স তিনটি নিয়ে নিয়মিত বাহিনী গড়ে উঠেছিল। নিচে এ ফোর্সের দায়িত্বে নিয়োজিত সামরিক অফিসারদের নাম উল্লেখ করা হলো:

১. ‘Z’ ফোর্স: এ ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান।

২. ‘K’ ফোর্স: প্রথমে লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ এ ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন এবং খালেদ মোশাররফ গুরুতর আহত হলে মেজর আবু খালেক চৌধুরী অস্থায়ীভাবে এর অধিনায়ক হন।

৩. ‘S’ ফোর্স: মেজর লে. কর্নেল কে. এম. শফিউল্লাহ ছিলেন এ ফোর্সের অধিনায়ক।

অনিয়মিত বাহিনী: ছাত্র-যুবদের নিয়ে অনিয়মিত বাহিনী গঠিত হয়। গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য এদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এদেরকে বলা হতো ফ্রিডম ফাইটার্স, সরকারি নাম ছিল গণবাহিনী।

মুজিব বাহিনী: মুজিব বাহিনীর জন্ম ভারতে। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বাছাই করা তরুণ এবং শিক্ষিত তরুণদের নিয়ে এ বাহিনী গড়ে উঠেছিল। এ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মণি, আব্দুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খান। বাংলাদেশ সরকার এবং সেক্টর কমান্ডারদের অজান্তে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ বাহিনীর জন্ম হয়েছিল।

আফসার বাহিনী: মেজর আফসার উদ্দীন আহমেদ ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানার মল্লিকবাড়ি গ্রামে একটি মাত্র রাইফেল নিয়ে তার বাহিনী গঠন করেন। তার বাহিনীতে প্রায় সাড়ে চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ভালুকা থানার রাজু এলাকায় পাক বাহিনীর সাথে একটানা ৪৮ ঘন্টা যুদ্ধ করে আফসার বাহিনী কৃতিত্বের পরিচয় দেয়।

কাদেরিয়া বাহিনী: বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইল অঞ্চলে এক দুর্ধর্ষ বাহিনী গড়ে উঠে, যা কাদেরিয়া বাহিনী নামে পরিচিত। বাংলাদেশের ভিতর থেকে তারা তাদের নিজস্ব নিয়মে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদের বাহিনীতে প্রায় ৩৫০ এর বেশি সৈন্য ছিল। এরা প্রায় সহস্রাধিক পাকিস্তানি সৈন্য খতম করে। অপরপক্ষে, এদের মাত্র ১৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারায়। পাক হানাদার বাহিনীর কাছে কাদেরিয়া বাহিনী ছিল মহাআতঙ্ক।

হেমায়েত বাহিনী: হেমায়েতউদ্দীন ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন হাবিলদার। ২৯ মে বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার বাটরা বাজারে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তার বাহিনীর উদ্বোধন করেন। হেমায়েত বাহিনী জুন মাসের মধ্যেই ফরিদপুর ও বরিশালের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করেন। এ বাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই গড়ে উঠেছিল এবং এর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৫,০৫৪ জন।

নৌবাহিনী: মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এজন্য কলকাতা পোর্ট কমিশনারের নিকট থেকে এমডি, পদ্মা এবং এমডি পলাশ নামে দুটি জাহাজ সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি জাহাজে দুটি করে ৪০ মিলিমিটার কামান স্থাপন করা হয়। আর ৩৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে জাহাজ দুটিকে নৌযুদ্ধের উপযোগী করে তোলা হয়। পাকিস্তান থেকে ৪৫ জন পালিয়ে আসা নৌ সেনা নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর গোড়াপত্তন হয়। নভেম্বর পর্যন্ত ৮৬০ জন নৌ কমান্ডোকে ট্রেনিং দেওয়া হয়। এরা অনেক সফল অভিযান চালিয়ে কোস্টার, ট্যাংকার, টাগ ও রড জাহাজের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। এছাড়া ১৪ আগস্ট বন্দরে কমান্ডো অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানের সম্ভার বহনকারী জাহাজ MV আল আব্বাস ও MV হরমুজ ডুবিয়ে দিয়েছিল।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনী: মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায়ে ২৮ সেপ্টেম্বর ডিমাপুরে এয়ার কমোডর এ. কে. খন্দকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্ম হয়। ভারত থেকে পাওয়া একটি ডাকোটা; একটি অটার বিমান এবং একটি এল্যুয়েট হেলিকপ্টার দিয়েই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়েছিল। এগুলোতে বসানো হয় ৩০৩ ব্রাউনিং মেশিন গান এবং বোঝাই করা কিছু রকেট ও ২৫ পাউন্ডের বোমা। প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন পি. আই. এ থেকে ডিফেক্ট করা ছয়জন বাঙালি পাইলট। ৩ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকা ও চট্টগ্রামে যেসব আক্রমণ ধারা রচনা করেছিল। তার প্রথম আক্রমণের কৃতিত্বের দাবিদার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উপর্যুক্ত সামরিক সংগঠনসমূহের অক্লান্ত পরিশ্রম ও জীবনের বিনিময়ে দীর্ঘ ৯ মাসের সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে উপর্যুক্ত সামরিক সংগঠন ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা এবং বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।