অথবা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্যারিসমা নেতৃত্বের বিবরণ দাও।
অথবা, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান লিখ।
উত্তরঃ ভূমিকা: আধুনিক বিশ্বে রাজনীতির ক্ষেত্রে ক্যারিসমা শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্যবিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যারিসমা বা সম্মোহনী শক্তির অধিকারী নেতার আবির্ভাব যখন-তখন ঘটে না। সব সময় সব দেশে এ ধরনের নেতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। দেশের চরম দুর্দিনে জাতি যখন গভীর সংকটের আবর্তে হাবুডুবু খেতে থাকে, তখন কোনো কোনো স্থানে জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে ‘ক্যারিসম্যাটিক’ নেতার আবির্ভাব ঘটে। এমনি এক নেতার আবির্ভাব ঘটেছিল বাংলাদেশেও। তিনি বাঙালির নয়নের মণি, পরম শ্রদ্ধার পাত্র, জাতির দিশারি ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
জাতি ও দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্যারিসমা নেতৃত্বের ভূমিকা: ক্যারিসমা নেতৃত্বের ভূমিকায় শেখ মুজিবুর রহমান যে অবদান রেখেছেন তা নিচে উপস্থাপন করা হলো:
১. একাত্মতা সৃষ্টি: পাকিস্তান শাসনামলে এদেশের কতিপয় সংকটের দরুন একাত্মতা সৃষ্টিতে মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন ক্যারিসম্যাটিক নেতা হিসেবে সে সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি জাতীয়তাবাদী শক্তিকে একত্রিত করে জনগণকে একাত্মতার পতাকাতলে সমবেত করেন।
২. আপসহীন নেতৃত্ব: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বঞ্চিত জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আপসহীনভাবে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। অন্যায়ের কাছে তিনি কোনো অবস্থাতেই মাথা নত করেননি। জেল, জুলুম, অত্যাচার কোনোকিছুই তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছেন লক্ষ্য হাসিলের জন্য। তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, অদমনীয় কর্মস্পৃহা, অপূর্ব বাচনভঙ্গি, সর্বোপরি তাঁর আকর্ষণীয় চারিত্রিক মাধুর্য তাঁকে ক্যারিসম্যাটিক নেতৃত্বের অধিকারী করে তুলেছিল।
৩. ছয়দফা কর্মসূচি: আইয়ুব খানের শাসনামলে শোষণ ও বঞ্চনার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা যখন মুক্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে ঠিক সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে তাঁর ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবি নিয়ে এগিয়ে আসেন। তাঁর নেতৃত্বে ও নির্দেশে ছয়দফা দাবি দলীয় কর্মীদের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র প্রচার করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে ছয়দফার ভিত্তিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানালে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান গণআন্দোলনে উদ্বেলিত হয়ে উঠে। এ আন্দোলনে তাঁর ক্যারিসমাসুলভ নেতৃত্বের প্রকৃষ্ট সাক্ষ্য বহন করে।
৪. জাতীয় নেতায় পরিণত হওয়া: ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঐতিহাসিক ছয়দফা প্রস্তাব ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। এ ছয়দফাকে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। আর এ কারণেই শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন শুরু করে। কিন্তু বাঙালিরা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলেই ছয়দফার সপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়। এ ছয়দফা আন্দোলনই পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জাতীয় নেতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে।
৫. ১৯৭০ সালের নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্যারিসমাসুলভ নেতৃত্বের আর একটি পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে। ইয়াহিয়া সামরিক আইনের মধ্যে নির্বাচন দেন এবং নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। নির্বাচনে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানে একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই ছিলেন ক্যারিসমাসুলভ নেতৃত্বের অধিকারী।
৬. গতানুগতিক সমাজব্যবস্থা অবসানের প্রচেষ্টা: ক্যারিসমাসুলভ নেতৃত্ব পুরাতন সমাজকে ভেঙে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়তে সহায়তা করে। এটা পুরাতন ও নতুনদের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানকে ভেঙে নিজস্ব আঙ্গিকে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রাণপণ চেষ্টায় এতে তিনি সফলতা লাভ করেন।
৭. বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হওয়া : ছয়দফা আন্দোলনের ভয়ে ভীত আইয়ুব সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার নিমিত্তে আগরতলা মামলা দায়ের করেন। এ মামলার বিচারকার্য চলার সময় পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও বুদ্ধিজীবীরা শেখ মুজিবুরের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠলে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী আগরতলা মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেওয়া এক গণসংবর্ধনায় জাতির পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
৮. একচ্ছত্র নেতৃত্ব লাভ: আইয়ুব খানের পতনের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরই ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ইয়াহিয়া খানের সে উদ্যোগ ১৯৭০ সালে সামনে রেখে অবতীর্ণ হলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি পরম আস্থা প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন আওয়ামী লীগ লাভ করে।
৯. সফল রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের দ্বারা আইয়ুব সরকারের মতো লৌহমানবের যবনিকাপাত ঘটে। আইয়ুব সরকারের পতন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে নব দিগন্তের সূচনা করে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আদায়ের হাতিয়ারে পরিণত করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সে হাতিয়ারের রক্ষকে পরিণত করা হয়।
১০. স্বাধীনতা উত্তরকাল: ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। অল্পদিনের মধ্যেই ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার, অস্ত্র উদ্ধার, সংবিধান প্রণয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি জটিল কাজগুলো সম্পন্ন করে তিনি তাঁর সম্মোহনী নেতৃত্বের প্রমাণ দিয়েছিলেন। দেশের বাইরেও বাংলাদেশের সুনাম ও সুখ্যাতি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১১. স্বাধীন দেশের নেতৃত্বদান : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সুদীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালিরা স্বাধীনতা অর্জন করে এবং স্বাধীনতা অর্জনের অল্প কিছুদিন পরে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে বাংলাদেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর অসামান্য নেতৃত্বের জন্য দ্রুত ভারতীয় সৈন্যরা স্বদেশে ফিরে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্র সমর্পণ করে এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়।
১২. আতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ: পাক শাসনামলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীর মাঝে এক অভাবনীয়
জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটান। ফলে শত শত বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বেদীমূলে আত্মাহুতি দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের দরুন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। যদি তিনি ক্যারিসমাটিক নেতা হিসেবে এ ধরনের ভূমিকা পালন না করতেন তাহলে ইতিহাসের ধারা কোন দিকে প্রভাবিত হতো তা ঠিক করে বলা কঠিন ছিল।
১৩. স্বাধীনতা সংগ্রাম: ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্যারিসমার আরেকটি অন্যতম দিক। মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ৭ মার্চের ভাষণ। সে ভাষণ বাংলার সর্বস্তরের জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ক্যারিসমাটিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বাধিক পরিচিত। কিন্তু ক্যারিসমাটিক নেতার পতনের পিছনে সাধারণত যেসব দুর্বলতা কাজ করে তা মুজিবুরের জীবনেও কাজ করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের ন্যায় সম্মোহনী শক্তিসম্পন্ন মহান নেতার আবির্ভাব যদি বাংলার মাটিতে না ঘটত তবে দেশ স্বাধীন হতো কি না বলা যায় না। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের ভূমিকা যাই থাকুক না কেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের সম্মোহনী নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল সুদূরপ্রসারী।