বাংলাদেশের সংবিধানের উল্লেখযোগ্য সংশোধনীসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের সংবিধানের বিশেষ বিশেষ সংশোধনীগুলোর বিবরণ দাও।

উত্তর। ভূমিকা: আমরা জানি প্রতিটি রাষ্ট্রেই আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ও অন্যান্য নানাবিধ পরিবর্তিত পরিস্থিতির উদ্ভবে সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলার জন্য সংবিধানও পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বাতিল করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানও তার ব্যতিক্রম নয়। যুগের দাবি মিটাতে গিয়ে নানা কারণে বাংলাদেশের সংবিধানও এমনি পরিবর্তনের মাধ্যমে সংশোধন করা হয়েছে বার বার। এ যাবৎ বাংলাদেশ সংবিধানে পরিবর্তন বা সংশোধন আনা হয়েছে ১৬টি। নিচে এগুলোর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আলোচনা করা হলো:

প্রথম সংশোধনী: বাংলাদেশ সংবিধান প্রবর্তনের মাত্র ৭ মাস পরে প্রথম সংশোধনী বিল পাস হয়। ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই জাতীয় সংসদে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীটি গৃহীত হয়। এ সংশোধনী দ্বারা সংবিধানের ৪৭নং অনুচ্ছেদে একটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়। এ সংশোধনীর মূল কথা হচ্ছে গণহত্যা কিংবা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য কোনো সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য বা যুদ্ধবন্দিকে আটক, বিচার কিংবা শাস্তি প্রদান করার জন্য সরকার যে কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবেন এবং এ আইন সংবিধানের পরিপন্থি বলে গণ্য হবে না।

দ্বিতীয় সংশোধনী: ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় সংশোধনীটি সংসদে গৃহীত হয় এবং ২২ সেপ্টেম্বর আইনটি পাস হয়। এ সংশোধনীর বলে সংবিধানে জরুরি বিধানাবলি সংক্রান্ত নবম ভাগের সংযোজন করা হয়। এ সংশোধনীতে শাসন বিভাগকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়।

চতুর্থ সংশোধনী: ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আইন করা হয়। তৎকালীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এ আইন প্রবর্তন করা হয়। চতুর্থ সংশোধনী আইন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ সংশোধনী সরকারের ধারণাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। যেমন- ক. এ আইনের দ্বারা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং নতুনভাবে একটি উপরাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি করা হয়। তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পাঁচ বছরের জন্য নিযুক্ত হবেন। রাষ্ট্রপতিকে সাহায্য ও পরামর্শ দানের জন্য রাষ্ট্রপতির আনুকূল্যে গঠিত একটি মন্ত্রিপরিষদ থাকবে। তাঁরা রাষ্ট্রপতির সন্তোযক্রমে স্ব-পদে বহাল থাকবেন।

পঞ্চম সংশোধনী: বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী সংবিধান সংশোধনের প্রচলিত নিয়ম থেকে পৃথক ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে ১৯৭৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক শাসনামলে তৎকালীন সরকার কর্তৃক সাংবিধানিক পরিবর্তন এবং যাবতীয় কার্যক্রম পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধ করে দেওয়া হয়।

অষ্টম সংশোধনী: ১৯৮৮ সালের ৭ জুন তারিখে সংসদে অষ্টম সংশোধনী বিলটি গৃহীত হয়। এ সংশোধনী আইনে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরশাদ তাঁর বিরুদ্ধে অব্যাহত আন্দোলন ও বিক্ষোভকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভের আশায় ধর্মকে রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহারের পদক্ষেপ নেন। তাছাড়া মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন লাভের জন্য তাঁর ধর্মীয় আবেগ ও প্রতীক ব্যবহারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তবে অন্যান্য ধর্মের প্রতিও সম্মান প্রদর্শন ও নির্বিঘ্নে ধর্ম পালনের কথাও সংশোধনীতে বলা হয়।

দ্বাদশ সংশোধনী: বাংলাদেশের সাংবিধানিক বিবর্তনের ইতিহাসে দ্বাদশ সংশোধনী আইন অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যের অধিকারী। স্বাধীন বাংলাদেশ রাজনৈতিক জীবনের প্রারম্ভে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংসদীয় সরকারের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তখন থেকে ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনী আইন পাসের পূর্ব পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত ছিল। এরশাদ সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, নিরক্ষেপ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দল সংসদের ভিতরে ও বাইরে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। জনমতের প্রতি লক্ষ রেখে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার পক্ষে সম্মতি প্রদান করে। ফলে ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদে এক সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী আইন গৃহীত হয়। এ আইনের ফলে দীর্ঘ ১৬ বছর পর দেশে পুনরায় সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।

ত্রয়োদশ সংশোধনী: ২৭ মার্চ সংবিধানের ‘ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন’ গৃহীত হয়। ১৯৯৬ সালের এ আইন দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান করা হয়। অতঃপর ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া সরকার পদত্যাগ করে। পরবর্তীতে একজন প্রধান উপদেষ্টার সমন্বয়ে দশ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে সংবিধান অনুযায়ী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় এবং এর অধীনে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

পঞ্চদশ সংশোধনী: সংবিধানের প্রস্তাবনা, মূলনীতি, নির্বাচন ব্যবস্থা ও তফশিলসহ অনেকগুলো ধারায় ব্যাপক ও মৌলিক পরিবর্তনের বিধান সংবলিত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন আইন ২০১১ জাতীয় সংসদে পাস হয় ৩০ জুন ২০১১।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ সংবিধানের এ যাবৎ যে কয়টি সংশোধনী হয়েছে এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, অষ্টম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনীসমূহ ছিল নানা কারণে সমধিক গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখ্যযোগ্য। আমাদের উক্ত আলোচনার মাধ্যমে এ কথা পরিষ্কার যে, সংবিধানের এসব উল্লেখযোগ্য সংশোধনীর মাধ্যমে আমাদের দেশের সংবিধান ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মৌলিক ও গঠনমূলক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আর এজন্যেই উক্ত সংশোধনীগুলো অপেক্ষাকৃতভাবে অন্য সংশোধনীগুলো থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।