বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সম্পর্কে আলোচনা কর।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে তুমি কী আন? এ ঘোষণায় গুরুত্ব কতটুকু? আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু এ রাষ্ট্রেরই আরেকটি প্রধান অংশ বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তান শাসকবর্গ কর্তৃক সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং নানা দিক থেকে বঞ্চনা ও শোষণের শিকার হতে থাকে। এজন্য এ অঞ্চলের জনগণ এ শোষণের হাত থেকে মুক্তি লাভের জন্য সংগ্রাম করতে থাকে। বিস্ত পাকিস্তানি শাসকবর্গ এ সংগ্রামকে নিষ্প্রভ করার হীন চক্রান্তে মেতে উঠে। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ তারা নিরস্ত্র বাঙালির উপর বর্বর হামলা চালায়। এজন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ সময় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান তথা পাকিস্তানি শাসকবর্গের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল এদেশের মুক্তিসংগ্রামের মাইলফলক ও প্রেরণার উৎস। বিভিন্ন সময়ে একাধিক ব্যক্তি কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হলেও এর বিষয়বস্তু ও নির্দেশনা ছিল একই এবং এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব স্বীকৃত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় যে, তিনি পরোক্ষভাবে ঐ দিনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য যুদ্ধ প্রস্তুতির ঘোষণা দিয়েছেন। ঐদিন বিকালে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা বাঙালি সেনা কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে তার মতামত জানতে চাইলে তিনি সকলকে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেন। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চেয়েছেন এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টার পরপরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ঐদিন দিনের বেলা অর্থাৎ ২৫ তারিখে দিনে তিনি ঘটনা উপলব্ধি করে যে কোন জরুরি ঘোষণা প্রচারের লক্ষ্যে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকজন প্রকৌশলী নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে একটি ট্রান্সমিটার স্থাপন করেন বলে উল্লেখ আছে। গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং এ যোষণা ওয়‍্যারলেসযোগে চট্টগ্রাম প্রেরণ করেন এবং তিনি চট্টগ্রামের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের নিকট বাংলাদেশের স্বাধীনতার। ঘোষণা পৌছে দিয়ে তা প্রচারের নির্দেশ দেন। পরের দিন বিবিসির প্রভাতী অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি প্রচারিত হয়।

কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র স্থাপন ও স্বাধীনতার ঘোষণা সম্প্রচার: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতেই দেশের সকল রেডিও স্টেশন পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এ প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম.এ. হান্নানসহ কয়েকজন নেতার উদ্যোগে চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে যন্ত্রপাতি স্থানান্তরিত করে চট্টগ্রাম কালুরঘাট প্রেরণ কেন্দ্রটিকে বেতারকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয় এবং এর নাম দেওয়া হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র’ এবং এ বেতারকেন্দ্র থেকেই এম.এ. হান্নান, মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি প্রচার করেন। নিচে স্বাধীনতার ঘোষণা বর্ণনা করা হলো।

১. ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধসংক্রান্ত দলিলপত্র ও তথ্য সংকলিত আছে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র’ শীর্ষক গ্রন্থে। এ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণাটি সন্নিবেশিত রয়েছে। এ ঘোষণাটি ছিল ইংরেজিতে, যাতে বলা হয়- “This may be my last massage, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with what ever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on untill the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.” (এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত দেশবাসীকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।) স্বাধীনতার দলিলপত্রে আরো বলা হয়েছে যে, ২৫ মার্চ মধ্যরাত ও ২৬ মার্চ ইপিআর ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে এ বাণীটি দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌছে দেওয়া হয়।

২. ২৬ মার্চ, এম. এ. হান্নানের স্বাধীনতার ঘোষণা: এম. এ. হান্নান ২৬ মার্চ দুপুরে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে যে ঘোষণা দেন তা ছিল নিম্নরূপ: “আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে তাঁর নামে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আপনারা যারা এ গোপন রেডিও হতে আমার এ ঘোষণা শুনছেন তারা অন্যদের নিকট এ বাণী প্রচার করবেন। আর যার নিকট যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করুন এবং দেশকে মুক্ত করুন।”

৩. ২৭ মার্চ, মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণা: আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা একজন সামরিক কর্মকর্তার দ্বারা পাঠ করার গুরুত্ব অনুধাবন করেন। নিকটস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে পদমর্যাদায় সিনিয়র মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের জন্য অনুরোধ জানানো হলে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যাবেলা কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। তার ঘোষণাটি ছিল ইংরেজিতে। যার বাংলা অর্থ- “আমি মেজর জিয়া, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী প্রধান সেনাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি ঘোষণা করছি, আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে সার্বভৌম বৈধ সরকার গঠন করছি। আমরা অঙ্গীকার করছি যে, এ সরকার আইন ও সংবিধান মতে দেশ চালাবে। এ নতুন গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষ থাকবে। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সাথে এ সরকার বন্ধুত্ব কামনা করে এবং বিশ্বশান্তির জন্য কাজ করে যাবে। আমি সকল সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি তারা যেন বাংলাদেশের বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের জনমত গড়ে তোলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে বাংলাদেশ সরকার সার্বভৌম ও বৈধ। এ সরকার বিশ্বের গণতন্ত্রী জাতির স্বীকৃতি প্রত্যাশা করে।”

৪. ১০ এপ্রিল, স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা: ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ঘোষণাটি ছিল ইংরেজিতে, যার বাংলা অর্থ “……. বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান এবং …….. সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন, আমরা সেই বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিরা একটি গণপরিষদে গঠিত হয়ে পারস্পরিক আলোচনা করে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বলবৎ রাখার জন্য বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূণে ঘোষণা করছি এবং এতদ্বারা পূর্বাহ্ণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি। আমরা আরো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এ স্বাধীনতা ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে কার্যকর বলে গণ্য হবে।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার গুরুত্ব: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি ঘোষণাই ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। তবে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ঘোষণাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটি নির্বাচিত সরকার এ ঘোষণা দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধ এ সরকারের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চ ঘোষণা থেকে এটি কার্যকর বলে গণ্য হয়। বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার ঘোষণাকে তার নির্দেশ হিসেবে গণ্য করে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীনতার ঘোষণা বিরল সাক্ষ্য বহন করে। কেননা পৃথিবীর মাত্র দুটি দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপরটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল এদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রেরণার উৎস ও মাইলফলক। যার প্রেক্ষিতেই বাঙালি সশস্ত্র সংগ্রামে নেমে পড়ে ও ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার সূর্যটি ছিনিয়ে আনে।