অথবা, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার স্পৃহা, ক্রমবিকাশমান স্বাধীনতার চেতনা, রাজনৈতিক সংগঠন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এর ঘটনাপ্রভাব সমন্বিত করে কীভাবে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটল তা বর্ণনা কর।
অথবা, মহান মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি প্রবন্ধ লিখ।
উত্তরা। ভূমিকা: বিশ্বের স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাসের পাতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক অমর অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্ত আর লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা একদিনে অর্জিত হয়নি। ইতিহাসের বিভিন্ন ঘাতপ্রতিঘাতকে মোকাবিলা করে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা। তাই মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য বুঝতে হলে এর পটভূমি জানা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য হলো জাতীয় স্মৃতিসৌধ, যা স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সাতটি পর্যায়ের নিদর্শনস্বরূপ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সাতটি পর্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি: ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পটভূমিকে ৭টি পর্যায়ে বিভক্ত করে এর আলোচনা করা যায়। নিম্নোক্ত ৭টি পর্যায় হলো:
১. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন।
২. ১৯৫৪ সালের নির্বাচন।
৩. ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
৪. ১৯৬২ এর ছাত্র আন্দোলন।
৫. ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন।
৬. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান।
৭. ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ।
নিচে এ পর্যায়গুলো সম্পর্কে আলোচনা উপস্থাপন করা হলো:
১. ভাষা আন্দোলন: ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের পূর্ব অংশে ভাষা বিতর্কের ধারাবাহিকতায় নতুন রাষ্ট্রের রাজধানী করাচিতে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর ফলে পূর্ব বাংলার ছাত্র বুদ্ধিজীবী মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু এবং ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে পরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রথম আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করেন, কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়। এর ফলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করার জন্য গড়ে উঠে বিভিন্ন সংগঠন। যেমন- তমদ্দুন মজলিস, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ অন্যতম। ভাষা আন্দোলনের এ পর্যায়ে এসব সংগঠন বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। পূর্ব বাংলায় বিক্ষোভ সমাবেশ, ধর্মঘট চলতে থাকে। এমন পরিস্থিতি ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির লক্ষ্য ছিল উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিয়ে জিন্নাহর ঢাকা সফরকে কন্টকমুক্ত করা। ঢাকা আগমনের পর ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় জিন্নাহ ঘোষণা দেন “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে সরকার এ উদ্যোগ থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৯৫২ সালে। খাজা নাজিমুদ্দিন (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে ছাত্রসমাজের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি ভঙ্গ করে ১৯৫২ সালে ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এতে পূর্ব বাংলার ছাত্র জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। একুশে ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট ও বিক্ষোভ সমাবেশ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সরকার একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে সমাবেশ ও মিছিল বের করলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে এবং এতে সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকে শহিদ হয়। বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে রচিত হয় এক রক্তাক্ত অধ্যায়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
২. ১৯৫৪ সালের নির্বাচন: পাকিস্তান রাষ্ট্রে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বাঙালিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বরে আওয়ামী মুসলিম লীগ, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, মওলানা আতাহার আলীর নিজাম-ই-ইসলাম এবং হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রী দল মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং ২১ দফা সংবলিত একটি বিস্তৃত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, যা ঐতিহাসিক ২১ দফা নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট এককভাবে ২২৩টি আসন এবং সরকারি দল মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন লাভ করে।
যুক্তফ্রন্টের বিজয় ও এ নির্বাচনের গুরুত্ব: ১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ছিল অতান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের ব্যাপক ভরাডুবি হয় এবং রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পূর্ব বাংলা থেকে বস্তুত এ দলের উচ্ছেদ ঘটে। ২১ দফা কর্মসূচির ১৯ নম্বর দফায় বর্ণিত পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা ইত্যাদি দাবি আরো জোরদার হয়ে যাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পেশকৃত ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচিতে রূপ নেয়। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির ফলে সরকার ৫৬ দিনের মাথায় যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে বাতিল করে। এ ঘটনা বাঙালিদের প্রচণ্ডভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে।
৩. ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন: ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা কর্তৃক দেশে সামরিক শাসন জারির মাত্র ২০ দিনের মধ্যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান এক পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে এবং ১৯৬২ সালে আইয়ুবি সংবিধান প্রণীত হলে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধে।
৪. ১৯৬২ এর ছাত্র আন্দোলন: মূলত ৩টি বিষয়কে কেন্দ্র করে ১৯৬২ এর আইয়ুব শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলন
গড়ে উঠে। যথা:
ক. সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার: ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি আইয়ুব সরকার হঠাৎ করাচিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্সীকে গ্রেফতার করে। সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে প্রথম প্রহরে আইয়ুব বিরোধী বিক্ষোভ ও আন্দোলন অনুষ্ঠিত হয়।
খ. ১৯৬২ এর আইয়ুবি শাসনতন্ত্র: ১৯৬২ সালে ১ মার্চ আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের আলোকে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন। নতুন শাসনতন্ত্র জারি হওয়ার সাথে সাথে পূর্ব বাংলায় আইয়ুব বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন রূপ পরিগ্রহ করে।
গ. শরিফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট: একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি আইয়ুব খান অধ্যাপক এস. এম. শরিফকে প্রধান করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করে। ১৯৬২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর আইয়ুব বিরোধী ছাত্র আন্দোলন আরো বেগবান হয়। এছাড়াও আইয়ুব শাসনামলে পাকিস্তানের উভয় অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্য বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব ঘটাতে সাহায্য করে।
৫. ১৯৬৬ সালের ছয়দফা : পাকিস্তানে আইয়ুব শাসন আমলে পূর্ব বাংলার বাঙালিদের মধ্যে যে স্বাধীনতার ভাবনা উদ্ভব হয় সেই পটভূমিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে লাহোর কনভেনশনে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন। এ ছয়দফা দাবিগুলোর মধ্যে ছিল ১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান ফেডারেশন, ২. ফেডারেশন সরকারের হাতে থাকবে দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত ক্ষমতা: অবশিষ্ট বিষয়সমূহ থাকবে প্রদেশের হাতে। ৩. দুই প্রদেশের জন্য পৃথক কিন্তু সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন, ৪. সকল কর ধার্য ও আদায় করার ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে, ৫. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব, ৬. পূর্ব পাকিস্তানে প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন। ছয়দফার প্রতি আইয়ুব সরকারের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত কঠোর। আইয়ুব সরকার এ প্রস্তাবকে বাংলা প্রতিষ্ঠার যড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে এবং ছয়দফা পন্থিদের হুমকি দেন, যা বাঙালিদের স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করে তোলে।
৬. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান: ছয়দফা কর্মসূচিভিত্তিক বাঙালি জাতীয় জাগরণকে দমন করতে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে আইয়ুব খান আগরতলা মামলার আশ্রয় নেয়। যেখানে শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামি করে ৩৫ জন বাঙালি সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। আগরতলা মামলার প্রাত্যহিক কার্যবিবরণী যতই বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হতে থাকে, বাঙালিরা ততই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। পূর্ব বাংলার আপামর জনতা ১১৪ ধারা লঙ্ঘন, কারফিউ ভঙ্গ, পুলিশ, ইপিআর, সেনাবাহিনী উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে পড়ে। ১৯৬৯ সালের দিকে অনেকে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় যা ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এর ফলে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতার মঞ্চ থেকে বিদায় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
৭. মুক্তিযুদ্ধ: ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক আহুত অসহযোগ আন্দোলন সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়লে ইয়াহিয়া-ভুট্টো আলোচনার জন্য ১৫ মার্চ ঢাকা আসেন। তারা যড়যন্ত্রের বেড়াজালে ঘেরা প্রহসনমূলক আলোচনা করতে থাকে। অতঃপর আলোচনার সমাপ্তি না করেই ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা থেকে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে এবং ২৫ মার্চ কালরাতেই শুরু হয় নিরস্ত্র বাঙালির উপর বর্বরোচিত হামলা। গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অতঃপর মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
উপসংহার: দীর্ঘ আন্দোলন আর ত্যাগতিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ৩০ লক্ষ শহিদের রক্ত, বহু মা-বোনের সম্ভ্রম, আর দেশবরেণ্য অসংখ্য বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যা এবং দেশের অবকাঠামোর এক ধ্বংসস্তূপের উপর উদিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লাল সূর্যটি। যেটা বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের।