অথবা, বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্র্যাকের অবদান আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্র্যাকের কার্যক্রম বিস্তারিত লিখ।
অথবা, বাংলাদেশের গ্রামীণ দরিদ্র জনগণেরর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ব্যাকের অবদান আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ফজলে হাসান আবেদ এর উদ্যোগে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সাল থেকে জনগণের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও কল্যাণ নিশ্চিত করা কাজ শুরু করে। বর্তমানে ব্র্যাক দারিদ্রদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্র্যাকের ভূমিকা: ব্র্যাক দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে যেসব ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে থাকে তা নিম্নে ছকের সাহায্যে দেখানো হলো:
দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্র্যাক বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. গ্রাম সংগঠন গড়ে তোলা: ব্র্যাক গ্রামের জনগোষ্ঠী বিশেষত ভূমিহীন ও দরিদ্রদের গ্রাম সংগঠনের অধীনে নিয়ে এসে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালায়। ৪০-৪৫ জন সদস্য নিয়ে এ সংগঠন গড়ে ওঠে। এতে মহিলাদের অংশগ্রহণের প্রতি জোর দেয়া হয়। গ্রাম সংগঠনের সদস্যগণ প্রতি মাসে একবার আলোচনা সভায় মিলিত হয়। এ সভার শিক্ষা, মানবাধিকার, স্যানিটেশন, নারী নির্যাতন, অন্যান্য অত্যাচার প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা কাল সদস্যদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা এ সভার মূল লক্ষ্য। ২০০৬ পর্যন্ত ১,৭০,২৭৭ টি সংগঠন তৈরি হয়েচে যার সদয় সংখ্যা ৫.৩১ মিলিয়ন।
২. ক্ষুদ্র ঋণঃ ১৯৭৪ সাল হতে ব্র্যাক ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। ব্র্যাক জামানত ছাড়াই সদস্যদের নিজেদের ভোগ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, হাঁস-মুরগি গরু-ছাগল পালন প্রভৃতি কাজের জন্য ঋণ দিয়ে থাকে। ডিসেম্বর ২০০৭ পর্যন্ত ব্র্যাক ২৮৬৭ টি শাখা অফিসের মাধ্যমে ২,৫০,৭৮৫টি গ্রাম সংগঠনের মাধ্যমে ৭.৩৭ মিলিয়ন দলীয় সদস্যদের ৬.৪ মিলিয়ন সক্রিয় ঋণ গ্রহীতাদের প্রতি মাসে গড়ে ৫১৯৪ মিলিয়ন টাকা ঋণ দেয়। ব্র্যাকের ঋণ পরিশোধের হার ৯৯.৫৪%।
৩. ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও সহায়তাঃ ব্র্যাক ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও বিদ্যমান ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঋণদানের মাধ্যমে ব্যবসা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ১৯৯৬ সালে এ কার্যক্রম চালু করে। এ কর্মসূচির আওতায় ঋণগ্রহীতাদের ২০,০০০ টাকা হতে ২,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া হয়। ডিসেম্বর ২০০৭ পর্যন্ত এ কার্যক্রম হতে ৭,৩৭,০০০ জন ঋণগ্রহীতার মধ্যে ৫৩৪ মিলিয়ন ডলার বিতরণ করা হয়েছে।
৪. উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমঃ ব্র্যাক ১৯৮৫ সালে ২২টি স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উপানুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে ৩৪,০০০ এর বেশি সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ব্র্যাক স্কুলের মাধ্যমে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। এদের মধ্যে ৬৬ ভাগই মেয়ে শিশু যারা কখনও স্কুলের গণ্ডিতে প্রবেশ করে নি এরাই ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থী। ব্র্যাকের স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে ৯৭ ভাগই মহিলা এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দা। ব্র্যাক ৪ বছরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোর্স সম্পন্ন করে। এ যাবৎ ১.৫ মিলিয়ন শিশু ব্র্যাক স্কুল থেকে উত্তীর্ণ হয়ে ৯০ ভাগ শিশু বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে ও ব্র্যাক কমিউনিটি ও স্কুলে লাইব্রেরি কার্যক্রম, বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা ৭,২৬০টি এবং কমিউনিটি লাইব্রেরির সদস্য সংখ্যা ২ লক্ষের বেশি।
৫. স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যার কার্যক্রমঃ ডায়রিয়া বাংলাদেশের জন্য এক মহামারী। ১৯৮০ সালে ব্র্যাক এ মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মহিলা কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লবণ ও গুড় দিয়ে কিভাবে শরবত বানাতে হয় তা শিখিয়ে দিয়ে আসে। যার ফলে আজ ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হলো শিশু ও মায়েদের রোগ-শোক এবং মৃত্যুর ঝুঁকি কমিয়ে আনা, সে সাথে শিশুর জন্মহার কমানো, শিশু, বয়স্ক ও মহিলাদের পুষ্টিমান উন্নত করার মাধ্যমে দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্য কায়েম করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্র্যাক বর্তমান ৪টি ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। যথাঃ
(ক) প্রজনন স্বাস্থ্য ও রোগ নিয়ন্ত্রণ।
(খ) স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সহায়ক কর্মসূচি।
(গ) অপরিহার্য স্বাস্থ্য সেবা ছাড়াও রয়েছে ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কেন্দ্র।
(ঘ) পুষ্টি সহায়ক কর্মসূচি।
৬. ব্র্যাক শহর উন্নয়ন কার্যক্রমঃ ব্র্যাক ১৯৯৮ সাল থেকে শহর উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করেছে। এর আগে ১৯৯২ সালে ১০টি স্কুল চালুর মাধ্যমে এ কার্যক্রমের সূত্রপাত হয়। ব্র্যাক শহর উন্নয়নের জন্য যেসব কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। তা নিম্নে দেওয়া হলোঃ
(ক) অর্থনৈতিক কার্যক্রমঃ অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি, ক্ষুদ্র উদ্যোগের ঋণ প্রদান, সঞ্চয় কার্যক্রম। অর্থনৈতিক কার্যক্রমের আওতায় এ যাবৎ ১৩৭০টি সংগঠন, ৪১,০০০ সদস্য ও ২২ মিলিয়ন টাকা সঞ্জয় করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৩২ মিলিয়ন টাকা।
(খ) স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমঃ স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে রয়েছে মাতৃ শিশু স্বাস্থ্যসেবা, স্যালাইন তৈরি ইপিআই কার্যক্রম, এইচ আইভি/এইডস সচেতনতা, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি প্রভৃতি।
(গ) শিক্ষা কার্যক্রমঃ শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় ৪টি মেট্রোপলিটন সিটিতে প্রায় ১৫০০টি স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। এ শিক্ষাক্রমের আওতায় রয়েছে গার্মেন্টস থেকে প্রত্যাগত ১৪ বছরের নিচের বয়সী শিশুদের জন্য প্রায় ২৮০০টি স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
৭. মৎস্য চাষঃ মানিকগঞ্জ জামালপুর ও সিলেটে ১৬টি পুকুর খননের মধ্য দিয়ে ১৯৭৬ সালে ব্র্যাক কর্মসূচি চালু করে এবং এটি ইতোমধ্যে সর্বাধিক লাভজনক খাত হিসেবে পরিচিত হয়েছে। বর্তমানে ২,৭৭,০০০ জন এ কর্মসূচির আওতায় ২,৮০,০০০ একর পুকুরের মৎস্য চাষ করছে।
৮. প্রশিক্ষণঃ ব্র্যাক ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের পাশাপাশি ঋণের সম্বব্যবহার করার জন্য ঋণগ্রহীতাদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রধান করে থাকে। ব্র্যাক কৃষি, হাঁস মুরগি ও পশু পালন, ব্যবসার প্রভৃতি কাজে সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে।
৯. সামাজিক বনায়নঃ অব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত জমিতে ব্যাপকভিত্তিক বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য ব্র্যাক এ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ব্র্যাক ২০,০০০ কৃষি ফার্ম স্থাপন করে ৮,৮২০ একর জমিতে বনায়ন কাজ করছে। যা জাতীয় পর্যায়ে ১৫টি বড় নাসরিী ও ছোট ৮,০৯৯টি নাসরিী কাজ করছে। ব্র্যাক ২০০৭ সালে ১.৩৫৮ টন সবজি এবং প্রায় ৮৩৭টন আলু ইউরোপ, আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর এরং মালয়েশিয়ায় বাজারজাতকরণ করে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ব্র্যাক দরিদ্রতা দূরীকরণ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে যেসব উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা যথাযথভাবে পালন করেছে। ফলে দরিদ্র জনসাধারণের স্বার্থ, মানবাধিকার ও আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।