অথবা, বাংলাদেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমস্যা সমাধানের উপায় আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমস্যা বা বাধাসমূহগুলো বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধগুলো ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: ভূমিকা: বাংলাদেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। এদেশে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এসব পরিকল্পনার লক্ষ্যার্জন, কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনে নানা কারণেই সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১. বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে মূলধনের স্বল্পতা। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ সম্পর্কে বা অর্থের যোগান খুবই সীমিত।
২. এদেশে সুশাসনের অভাব ও দুর্বল প্রশাসন ব্যবস্থা ও পরিকল্পনার বাস্তবায়নে অন্যতম বাধা হিসাবে বিবেচিত।
৩. পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবেও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না।
৪. পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আরেকটি অন্যতম সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা, ফলে পরিকল্পনার লক্ষ্যার্জন ব্যাহত হচ্ছে।
৫. বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগও তেমনভাবে হচ্ছে না। ফলে পরিকল্পনার উপর এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
৬. এদেশের রপ্তানি আয় খুবই কম। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা তেমনভাবে অর্জিত হচ্ছে না। এটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অন্যতম বাধা। এদেশে দক্ষ ও অভিজ্ঞ পরিকল্পনাবিদদের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
৭. সরকারি খাতের অদক্ষতা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আরেকটি বাধা। কেননা সরকারি ক্ষেত্রে যে সকল পরিকল্পনাবিদ কাজ করে তারা অধিকাংশই অনভিজ্ঞ।
৮. ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। এদেশে প্রতিবছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। ফলে যে সকল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তা যথাযথভাবে বাস্ত বায়ন করা সম্ভব হয় না।
৯. যোগ্যতাভিত্তিক জনগণের অংশগ্রহণের অভাবে অনেক সময় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। কারণ কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথম কাজ হচ্ছে জনগণের সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
১০. পরিকল্পনাবিদদের অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
১১. বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয় বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতার উপর নির্ভর করে। বৈদেশিক ঋণ বলতে কোনো দেশের দাতা সংস্থা বা দেশের সরকার কর্তৃক অনুদানকে বলা হয়। উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্ত বায়নে বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন হয়। এছাড়াও রয়েছে প্রতিকূল আর্থ-সামাজিক অবস্থা, জনসংখ্যার আধিক্য, নির্দিষ্ট সময়ের অভাব, বিনিয়োগের অপর্যাপ্ততা, যথাযথ জবাবদিহিতার অভাব প্রভৃতি সমস্যার কারণে পরিকল্পনাকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমস্যা সমাধানের উপায়ঃ বাংলাদেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমস্যা সমাধানের উপায়সমূহ নিচে তুলে ধারা হলোঃ
১. মূলধনের পর্যাপ্ততাঃ যে-কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে পর্যাপ্ত মূলধনের প্রয়োজন হয়। তাই বাংলাদেশে যে সকল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, সে অনুযায়ী পর্যাপ্ত অর্থ বিনিয়োগ করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এ মূলধন অভ্যন্তরীণ ও বাহির থেকে আসতে পারে।
২. সুশাসন ও সবল প্রশাসন ব্যবস্থা: সুশাসন ও সবল প্রশাসন ব্যবস্থা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল ও অকার্যকর। তাই পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে পরিকল্পনাবিদদের যথাযথ জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে এবং যদি কেউ জবাবদিহিতা দানে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তির বিধান চালু করতে হবে।
৩. পর্যাপ্ত তথ্য বা উপাত্তঃ যে বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ বা প্রণয়ন করা হয় সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তথ্যের সমারোহ থাকতে হবে। কেননা একটা পরিকল্পনা সফলতা লাভ করে তার যথাযথ তথ্যের উপর ভিত্তি করে। পরিকল্পনার ক্ষেত্রে যে সকল তথ্য সংগ্রহ করা হবে তা অবশ্যই যুক্তিসংগত ও বিবেচনাযোগ্য হতে হবে এবং অগ্রহণযোগ্য তথ্যগুলো বাদ দিতে হবে।
৪. সুনির্দিষ্ট সময়ঃ পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সকল কার্যাবলি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। কেননা সুনির্দিষ্ট সময় ব্যতীত কোনো পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায় না। যেমনঃ বার্ষিক পরিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা।
৫. সম্পদের পূর্ণ ব্যবহারঃ একটি আদর্শ পরিকল্পনার অন্যতম দিক হলো এতে সম্পদ ও সুযোগের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। তাই সম্পদের অপব্যয় পরিকল্পনায় নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় সম্পদ সীমিত। এই সীমিত সম্পদকে এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিকল্পনার সঠিক বাস্ত বায়ন সম্ভব হয়।
৬. দক্ষ পরিকল্পনাবিদ নিয়োগঃ পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন নির্ভর করে একজন দক্ষ পরিকল্পনাবিদের উপর। কিন্তু আমাদের দেশে যে সকল পরিকল্পনাবিদ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করে তারা অধিকাংশই অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ। ফলে তারা পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়নে ব্যাহত হয়। তাই পরিকল্পনার কাজে কোনো ব্যক্তি নিয়োজিত করতে হলে পূর্বে তাকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে।
৭. বাস্তবমুখী পরিকল্পনাঃ কোনো দেশে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে তার বাস্তব অবস্থা বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর ভিত্তি করে। কেননা পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কর্মসূচি, কলাকৌশল, নীতি প্রভৃতি সব কিছুই হতে হবে বিজ্ঞান সম্মত ও যুগোপযোগী।
৮. প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা: পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে বাধা সৃষ্টিকারী প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেবলমাত্র একটি দেশের কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলকে ক্ষতিসাধন করে না বরং দেশের সকল ক্ষেত্রেই এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
৯. জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ: কোনো পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমেই জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় অনেক নিম্নমুখী। ফলে অধিকাংশ জনগণ অশিক্ষিত। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো পরিকল্পনা যথাযথ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।
১০. দুর্নীতি ও অনিয়ম দূরীকরণঃ কোনো পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় হলো দুর্নীতি ও অনিয়ম। দুর্নীতির কারণে একটি পরিকল্পনার যে-সকল কার্যক্রম গৃহীত হয় তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। তাই পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমেই দুর্নীতি ও অনিয়ম দূরীভূত বা কমাতে হবে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
১১. রাজনৈতিক ও সামাজিক বা স্থিতিশীলতা অর্জনঃ বাংলাদেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও এর সুফল পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা অত্যাবশ্যক। কারণ যে কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় সে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিবেশের উপর ভিত্তি করে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে।
১২. সুন্দর ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিঃ পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন নির্ভর করে একটি দেশের সুন্দর ও অনুকূল পরিবেশের উপর। কিন্তু বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের একটি সমস্যার সাথে অন্যান্য সমস্যাগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা একটি কঠিন বিষয়। তবুও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে উত্তম সমস্যাবলি মোকাবেলা করে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যক।
১৩. নমনীয় ও সহজবোধ্যতা: পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয় যাতে এটি নমনীয় ও সহজবোধ্য হয়। এর ফলে পরিকল্পনা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এখনো পুরোপুরি সফলতা অর্জন করতে পারেনি। তাই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা অত্যাবশ্যক। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতের সংস্কারও সম্প্রসারণ, জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন, দক্ষ পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ, দুর্নীতি প্রতিরোধ, মূলধনের উৎস বৃদ্ধি, রপ্তানি আয় বাড়ানো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় অধিকতর মনোযোগ ও মূল্যায়ন প্রভৃতি অপরিহার্য। ফলে পরিকল্পনা সফল, কার্যকরী ও ফলপ্রসূ হবে।