বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গঠন প্রণালি আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গঠন প্রণালি সম্পর্কে বর্ণনা কর।

উত্তর : ভূমিকা: রেডক্রস একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। রেডক্রস যুদ্ধাহত, দুর্ভিক্ষপীড়িত, দুর্যোগকবলিত মানুষের পাশে খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি সাহায্য নিয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে অবশ্যই এর নাম রেডক্রিসেন্ট হয়েছে। এটি বাংলাদেশে দরিদ্র-অসহায় বঞ্চিত নারী শিশু ও পুরুষদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। কতকগুলো লক্ষ্যে ও উদ্দেশ্য নিয়ে আর্তমানবতার সেবা করে চলেছে এটি। এর সার্বিক কার্যক্রম ও সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। তাই বাংলাদেশে এর কার্যকারিতা অনেকটাই বেড়ে চলেছে।

বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটঃ বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিম্নঃ রেডক্রসের জন্মদাতা ছিলেন সুইজারল্যান্ডের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হেনরি ডুনান্ট। ১৮৫৯ সালের ২৪ জুন ইতালির সলফ্যারিনো নামক ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধাহতরা বিনা চিকিৎসায় ছটফট করতে থাকে। তিনি এ. বেশ মর্মাহত হন পাশের গ্রামের কিছু মহিলাকে নিয়ে যুদ্ধাহত সৈনিকদের সেবা-শুশ্রুষা করেন। পরবর্তী সময় ১৮৬৩ সালের ২৬ই অক্টোবর ১৬টি দেশের প্রতিনিধি সমন্বয়ে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। আর এ সম্মেলনেই আন্তর্জাতিক রেডক্রস সমিতি গঠিত হয়। ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে এর কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১০ সালের রেডক্রস অ্যাক্টের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে রেডক্রসের কার্যক্রমের সূচনা ঘটে। পরবর্তীতে ভারত-পাকিস্তান ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে রেডক্রসের যাত্রা ঘটে। ১৯৭২ সালের ৪ই জানুয়ারিতে সরকারের আদেশ অনুযায়ী রেডক্রস গঠিত হয়। কিছু বছর চলার পরে ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রপতির এক আদেশবলে রেডক্রসের নাম পরিবর্তন করে রেড ক্রিসেন্ট রাখা হয়। বর্তমানে রেড ক্রিসেন্ট নামেই বাংলাদেশে এর সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের রেডক্রিসেন্টের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো নিম্নরূপঃ ১. দুর্যোগ ত্রাণ বিতরণ: দুর্যোগকালীন ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিভিন্ন ত্রাণ বিতরণ এর প্রধান উদ্দেশ্য। যাতে এসব মানুষ বেঁচে থাকার আশা না হারায়।

২. মা ও শিশু কল্যাণঃ মা ও শিশুর সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে পর্যাপ্ত পরিমাণে মাতৃমঙ্গল ও শিশুমঙ্গল কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা ও তা পরিচালনা করাও আরেকটি লক্ষ্য।

৩. স্বাস্থ্য উন্নয়ন: সাধারণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য উন্নয়ন সাধন রেডক্রিসেন্টের অন্যতম একটি লক্ষ্য। এজন্য রোগব্যাধি চিহ্নিতকরণ তা প্রতিকার ও প্রতিরোধের পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টি করে থাকে।

৪. প্রাথমিক চিকিৎসা: দান ও নার্স প্রশিক্ষণ দান রেড ক্রিসেন্ট প্রাথমিক চিকিৎসা দান ও নার্সিং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে।

৫. বাংলাদেশি সৈন্যদের সেবাদানঃ বাংলাদেশের নৌ, বিমান ও অন্যান্য সৈন্যদের আহত অবস্থায় সেবাদান করা ও এর একটি উদ্দেশ্য হিসেবে গণ্য হয়।

৬. দুর্দশা লাঘবে প্রচেষ্টা: সমাজের সকল মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে প্রচেষ্টা চালানো ও এর লক্ষ্য।

৭. রোগীদের সাহায্য সহযোগিতাঃ দেশের দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি সুষ্ঠুভাবে পুনর্বাসনের জন্য আর্থিক সহযোগিতাও প্রদান করে।

৮. জাতীয় শাস্তি সংরক্ষণঃ জাতীয় শান্তি শৃঙ্খলা সংরক্ষণ ও তা অব্যাহত রাখতে রেডক্রিসেন্ট সর্বদাই তৎপর থাকে।

৯. যুব সমাজের পরিবর্তন সাধনঃ গঠনমূলকভাবে যুবসমাজের পরিবর্তন সাধনই রেডক্রিসেন্টের অন্যতম লক্ষ্য বলে প্রতিভাত হয়ে উঠে।

১০. অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস পরিচালনাঃ সারাদেশের সমস্ত রোগীদের কল্যাণে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস পরিচালনা করাও বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্টের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গণ্য হয়।

বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির গঠন:

১. সাধারণ পরিষদঃ বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্টের সমস্ত নীতিনির্ধারণ ও বাজেট প্রণয়নের কাজগুলো সাধারণ পরিষদ কর্তৃক সম্পাদিত হয়। এক বছর পর পর একটি সভায় রিপোর্ট পেশের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও উত্থাপিত হয়ে থাকে। একটি সাধারণ পরিষদে যারা থাকেন তারা হলেনঃ

(ক) ২ জন নির্বাচিত ডেলিগেট।

(খ) ১ জন চেয়ারম্যান।

(গ) ১ জন কোষাধ্যক্ষ:

(ঘ) ব্যবস্থাপনা পরিষদের সব সদস্য।

(ঙ) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ১ জন।

(চ) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ১ জন

(ছ) ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ১ জন।

(জ) সমাজ কল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ১ জন।

২. ব্যবস্থাপনা প্ররিষদ: রেডক্রিসেন্টের কার্যক্রম বাস্তবায়নে একটি ব্যবস্থাপনা পরিষদ রয়েছে। তাতে ১ জন চেয়ারম্যান, ১ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ১ জন কোষাধ্যক্ষ ও ১২ জন সদস্য নিয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠিত হয়। এ ব্যবস্থাপনা পরিষদ ৩ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। এটি সমস্ত কর্মসূচি পরিচালনা করে থাকে।

৩. ইউনিটঃ দেশে সর্বত্র রেডক্রিসেন্টের কার্যক্রম প্রসারিত করতে দেশে ৬৮টি ইউনিটের জন্ম দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ইউনিটের কার্যক্রম আবার পরিচালিত হয় একটি কমিটির মাধ্যমে। ১১ জন সদস্য নিয়ে গঠিত প্রতিটি কমিটি ইউনিটের কার্যক্রমের বাস্তবায়ন করে।

৪. সচিবালয়ঃ বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সদর দপ্তরকেই সচিবালয় বলা হয়। এই সচিবালয় সমস্ত প্রশাসনিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। এর মাধ্যমেই সারাদেশের ইউনিটি কার্যক্রম চালাতে সক্ষম হয়ে উঠে।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির হচ্ছে মানবতার প্রতিষ্ঠায় এক অগ্রণী প্রতিষ্ঠান। এদেশের ভাগ্যাহতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে রেডক্রিসেন্ট বাস্তবসম্মত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির মাধ্যমে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাই রেডক্রিসেন্টের গুরুত্ব এ দেশে অত্যন্ত বেশি।