অথবা, বাংলাদেশের মূল সংবিধানের রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য বাংলাদেশ সংবিধান (১৯৭২) কী কী মূলনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল?
উত্তর। ভূমিকা: ১৯৭২ সালের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে অর্থাৎ ৮নং অনুচ্ছেদ থেকে ২৫নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ সন্নিবেশিত করা হয়েছে। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূল আদর্শ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং অন্য নীতিগুলো এ চারটি আদর্শ হতে উৎসারিত বলে ঘোষণা করা হয়। মূলত বাংলাদেশের মানুষ জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যে এক ঐতিহাসিক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি সংযোজিত হয়েছে।
১. জাতীয়তাবাদ: ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের চারটি প্রধান স্তম্ভের একটি অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। সংবিধানের ৯নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, সে জনগোষ্ঠীর ঐক্য বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। সুতরাং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারী সকলেই বাঙালি জাতির অন্তর্ভুক্ত নয়। বাঙালি জাতি প্রতিবেশী ভারতের বাংলাভাষী জনসম্প্রদায় হতে ভিন্ন। কারণ তাদের রাজনৈতিক ইতিহাস ও আশা-আকাঙ্ক্ষা ভিন্ন। পূর্ব বাংলার ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে বসবাসকারী যে জনগোষ্ঠী সংকল্পবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে সে জনগোষ্ঠীকেই বাঙালি জাতি বলে ঘোষণা করা হয়।
২. সমাজতন্ত্র: ১৯৭২ সালের সংবিধানের অপর একটি মৌলনীতি হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বিধিবিধানের উপস্থিতি। বাংলাদেশ একটি শোষণমুক্ত ও সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করা হবে। সংবিধানের ১০নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে যে, মানুষের ওপর মানুষের শোষণ অবসান করে ন্যায়ানুগ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা হবে। এ উদ্দেশ্যে সকল উৎপাদন যন্ত্র রাষ্ট্রের হাতে অর্পণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৩. গণতন্ত্র: ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলে পরিগণিত হবে। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে; মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে। এখানে নারী,. পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান থাকবে।
৪. ধর্মনিরপেক্ষতা: ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার অবসান। রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা না দেওয়া, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার না করা এবং ধর্মের ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তির প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বা নিপীড়নের অবসান। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা ছিল না। সকল নাগরিকের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা ছিল। এর মূল কথা ছিল রাষ্ট্র ধর্মের ব্যাপারে কোন পক্ষপাতিত্ব করবে না এবং ধর্মকে রাজনীতির বাইরে রাখতে হবে।
অন্যান্য মূলনীতি: উপর্যুক্ত চারটি নীতিকে বাংলাদেশ সংবিধানে মূলস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এগুলো ছাড়া রাষ্ট্রপরিচালনার আরো কিছু মূলনীতি রয়েছে। নিচে সেগুলো আলোচনা করা হলো:
১. মালিকানার নীতি: বাংলাদেশে তিন প্রকার মালিকানা থাকবে। (ক) রাষ্ট্রীয় মালিকানা, (খ) সমবায়ী মালিকানা ও
( গ) ব্যক্তিগত মালিকানা (অনুচ্ছেদ: ১৩)।
২. কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি: সংবিধানের ১৪নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে কৃষক, শ্রমিক ও জনগণের পাশ্চাৎপদ অংশকে সকল প্রকার শোষণ হতে মুক্তি দান করা।
৩. মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা: সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান ইত্যাদির ব্যবস্থা করবে।
৪. প্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব: ১৬নং অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লব ও কুটিরশিল্পের বিকাশ, বিদ্যুতায়ন এবং শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৫. শিক্ষানীতি: ১৭নং অনুচ্ছেদে একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান, নিরক্ষরতা দূর করা এবং সমাজের প্রয়োজনের সাথে শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৬. জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা: ১৮নং অনুচ্ছেদে জনগণের পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য। মদ্যপান নিষিদ্ধ এবং গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৭. সমতার নীতি: ১৯নং অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের নিশ্চয়তা, ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসামা বিলোপ এবং সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের জন্য রাষ্ট্র সচেষ্ট হবে।
৮. কর্মের নীতি: সংবিধানের ২০নং অনুচ্ছেদে কর্ম হচ্ছে প্রত্যেক সক্ষম নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়। প্রত্যেকের নিকট হতে যোগ্যতানুযায়ী ও প্রত্যেকের কর্ম অনুযায়ী এ নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করবে।
৯. নাগরিকের কর্তব্য: ২১নং অনুচ্ছেদে সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।
১০. পৃথকীকরণ নীতি: ২২নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র শাসন বিভাগ হতে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণের ব্যবস্থা করবে।
১১. জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষা: ২৩নং অনুচ্ছেদে জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে রাষ্ট্র। জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন করা হবে।
১২. আতীয় স্মৃতির নিদর্শন রক্ষা: ২৪নং অনুচ্ছেদে জাতীয় স্মৃতির নিদর্শন রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
১৩. আন্তর্জাতিক নিরাপতা রক্ষা: ২৫নং অনুচ্ছেদে সরকার আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, শান্তি, ও সংহতি জোরদার করা এবং মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করবে। জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের জন্য উপর্যুক্ত মূলনীতি একান্ত অপরিহার্য। সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করা, জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। তাছাড়া কাজ করা প্রত্যেক কার্যক্ষম নাগরিকের জন্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কাজেই রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিগুলো সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করতে পারলেই বাংলাদেশ একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে।