অথবা, বাকশাল কেন করা হয়? বাকশালের পটভূমি এবং এর গঠন আলোচনা কর।
উত্তরা ভূমিকা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তা বাকশাল নামে পরিচিত। বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে প্রচলিত সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বাতিল করে বাকশাল ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বাকশাল ব্যবস্থা ছিল একটি রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা। মহৎ উদ্দেশ্যে এই শাসনব্যবস্থা চালু করার কথা থাকলেও তা কার্যকর হতে পারেনি।
বাকশাল: বাকশাল পূর্ণনাম হচ্ছে “বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বলে বহুদলীয় সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং দেশের সমগ্র রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল নামক একটি একক রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাকশাল কার্যকর হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তা হতে পারেনি।
বাকশাল গঠনের প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর (অনুচ্ছেদ-১১৭ক) মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। উক্ত সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের রাষ্ট্রপতিকে প্রয়োজনমতো দেশে একমাত্র ‘জাতীয় রাজনৈতিক দল’ গঠনের ক্ষমতা দেওয়া হয়। উক্ত দলের নামকরণ, কর্মসূচি প্রণয়ন ইত্যাদি ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। এভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামক একটি একক জাতীয় দল গঠনের কথা ঘোষণা করেন। তিনি এর চেয়ারম্যান এবং বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ দলীয় সকল সংসদ সদস্য ও সকল মন্ত্রী এর সদস্য বলে গণ্য হন। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ৬ জুন বাকশালের গঠনতন্ত্র ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে দেশকে পরিত্রাণ এবং জাতিতে একক সত্তায় পুনর্গঠন করার তাগিদে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধু বাকশালকে ‘দ্বিতীয় আন্দোলন’ নামে অভিহিত করেন।
বাকশালের গঠনতন্ত্র: রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ৬ জুন বাকশালের গঠনতন্ত্র ঘোষণা করেন। নিচে বাকশালের গঠনতন্ত্র বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
কেন্দ্রীয় সংস্থা: বাকশাল ব্যবস্থায় দলের চেয়ারম্যানই সর্ব ক্ষমতার অধিকারী। দলের কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো হচ্ছে:
ক. কার্যনির্বাহী কমিটি,
খ. কেন্দ্রীয় কমিটি ও
গ. কাউন্সিল।
চেয়ারম্যানের পরেই সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন হচ্ছে একজন সাধারণ সম্পাদকসহ ১৫ জন সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি। চেয়ারম্যান সাধারণ সম্পাদকসহ ১৫ জনকেই মনোনীত করবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কার্যনির্বাহী কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলী দলের সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন। কেন্দ্রীয় কমিটির এক-তৃতীয়াংশ চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত হবেন। কোনো সংগঠন, সংস্থা বা কমিটির সদসাপদ শূন্য হলে তদস্থলে চেয়ারম্যান নতুন সদস্য নিয়োগ করবেন। দলীয় কাউন্সিলে চেয়ারম্যান ৫০ জন পর্যন্ত মনোনয়ন করতে পারবেন। কাউন্সিলে প্রতিনিধি প্রেরণের ব্যাপারে বিভিন্ন জেলা ও অঙ্গ সংগঠনের কোটা চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত কার্যনির্বাহী কমিটি ঠিক করবে। তাছাড়া বিভিন্ন সরকারি বা আধাসরকারি দফতর বা প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেশন, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীসমূহের প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যাপারে দলের চেয়ারম্যানের ইচ্ছাই প্রধান। চেয়ারম্যান এটি করলে গঠনতন্ত্রের যে কোনো ধারা পরিবর্তন, সংশোধন ও পরিবর্তন করতে পারবেন এবং একমাত্র চেয়ারম্যানই গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যা দান করতে পারবেন।
সদস্যপদ প্রাপ্তি: বাকশাল ব্যবস্থায় দলের সদস্যপদ প্রাপ্তির ব্যাপারটিও দলের চেয়ারম্যানের ইচ্ছাধীন। কারণ কার্যনির্বাহী কমিটির হাতেই সদস্যপদ প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ব্যবস্থায় সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীবৃন্দ এবং পুলিশ মিলিটারি সদস্যরাও দলের সদস্য হতে পারবেন। কিন্তু কে সদস্য হতে পারবেন আর কে পারবেন না তা সম্পূর্ণরূপে চেয়ারম্যানের ইচ্ছাধীন। এসব ক্ষেত্রে কোথায় প্রাথমিক ইউনিট করার অধিকার দেওয়া হবে এবং প্রাথমিক ইউনিটের সদস্য সংখ্যা কত হতে পারে তা ঠিক করবে চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত কার্যনির্বাহী কমিটি।
অঙ্গ সংগঠন: বাকশাল ব্যবস্থার অধীনে কোনো অদলীয় শ্রেণি ও পেশাভিত্তিক সংগঠন ও গণসংগঠন করার কোনো অধিকার নেই। ট্রেড ইউনিয়ন মাত্রই তাকে বাকশালের অঙ্গদল, শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। গঠনতন্ত্র অনুসারে বাকসালের ৫টি অঙ্গ সংগঠন ছিল তা হলো:
১. জাতীয় কৃষক লীগ,
২. জাতীয় শ্রমিক লীগ,
৩. জাতীয় মহিলা লীগ,
৪. জাতীয় যুবলীগ ও
৫. জাতীয় ছাত্রলীগ।
চেয়ারম্যানকে অন্যান্য ক্ষেত্রেও অঙ্গসংগঠন ও সংস্থা ইত্যাদি গঠন করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এসব অঙ্গ সংগঠন কার্যনির্বাহী কমিটির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কাজ করবে মর্মে স্থির হয়।
প্রশাসন ব্যবস্থা: ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন-বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সভায় রাষ্ট্রপতি এক নতুন প্রশাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করার কথা ঘোষণা করেন। এ নতুন ব্যবস্থায় বাংলাদেশের মহকুমাগুলোকে জেলায় রূপান্তরিত করে ৬০টি নতুন জেলা গঠন করে প্রতিটি জেলায় একজন গভর্নর নিয়োগের ও এক একটি প্রশাসনিক পরিষদ গঠনের বিধান করা হয়। জেলা গভর্নর হবেন পরিষদের প্রধান। এ ব্যবস্থা ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল।
নির্বাচন: বাকশাল ব্যবস্থায় দেশে বাকশাল চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত এবং উপকমিটি দ্বারা মনোনীত না হলে কেউ মনোনীত হতে পারবে না। কিন্তু এ দলের চেয়ারম্যান কীভাবে নির্বাচিত হবেন তার কোনো উল্লেখ গোটা গঠনতন্ত্রে নেই।
বাকশাল গঠনের উদ্দেশ্য: বাকশাল অর্থ কেবল একটি একক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা নয়। বাকশাল গঠনের মাধ্যমে কিছু সুনির্দিষ্ট সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু বাকশাল কর্মসূচির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। নিচে বাকশাল গঠনের উদ্দেশ্যাবলি আলোচনা করা হলো:
শৃঙ্খলা রক্ষা: বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর উদ্দেশ্যে। দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে বাকশাল গঠন করেন।
শোষণমুক্তি: বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেছেন শোষণমুক্তির উদ্দেশ্যে। বঙ্গবন্ধু এমন একটি গণতন্ত্র গঠন করতে চেয়েছেন যেখানে গণতন্ত্র হবে শোষিতের গণতন্ত্র, শোষণের গণতন্ত্র নয়।
দুর্নীতিবাজ মুক্ত করা: বাকশাল গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সমাজের ও দেশের রন্দ্রে রন্ধে অধিষ্ঠিত দুর্নীতি এবং
দুর্নীতিবাজদের খতম করা। দুর্নীতিমুক্ত একটি আদর্শ সমাজ গঠন করা।
আতীয় ঐক্য: জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্য বাকশাল গঠন করা, বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, “জাতীয় ঐক্য গঠন করার জন্য একদল করা হয়েছে।” যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসে, এর আদর্শে বিশ্বাস করে, চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ মানে তারা এ দলের সদস্য হতে পারবে। যারা দেশের শত্রু, বিদেশি দালাল তাদের স্থান নেই। সরকারি কর্মচারীগণও এ দলের সদস্য হতে পারবে। কারণ তারাও এই জাতির একটি অংশ। এজন্য সকলে যে যেখানে আছি একতাবদ্ধ হয়ে দেশের কাজে লাগতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বাকশাল গঠন করা হয়েছে।
সকলের অংশগ্রহণ: বাকশালে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। এখানে যেমন শ্রমিকদের অংশগ্রহণ রয়েছে। তেমনি, ছাত্র, যুবা, কৃষক ও মহিলাদেরও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে।
গ্রামীন উন্নয়ন: বাকশাল গঠনের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়নের রুদ্ধদ্বার খুলে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ এর উদ্দেশ্যে বাকশাল গঠন করেছেন। যাতে পাঁচ বছরের প্লানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচশত থেকে এক হাজার পরিবার পর্যন্ত নিয়ে কম্পালসরি কো-অপারেটিভ হবে।
সকলের অংশগ্রহণে প্রশাসনিক ব্যবস্থা: বাকশাল ব্যবস্থায় প্রত্যেকটি থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে। এই
কাউন্সিলে রাজনৈতিক কর্মী বা সরকারি কর্মচারী যেই হন একজন তার চেয়ারম্যান হবেন। এই থানা কাউন্সিলে থাকবে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সরকারি কর্মচারী। তার মধ্যে থাকবে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি, যুব প্রতিনিধি, কৃষক প্রতিনিধি। সমস্ত মহকুমা জেলা হয়ে যাবে। সেই জেলায় একটি করে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল হবে। তার চেয়ারম্যান থাকবে, সব কর্মচারী তার মধ্যে একসঙ্গে থাকবে, এর মধ্যে থাকবে পিপলস রিপ্রেজেন্টেশন থাকবে। পার্টি রিপ্রেজেন্টশন সকলের অংশগ্রহণে প্রশাসনিক ব্যবস্থা পরিচালিত হবে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাকশাল ব্যবস্থা তৎকালীন সময়ে অনেক সমালোচনার স্বীকার হয়েছিল। কিন্তু বুঝতে হবে তৎকালে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এক দলীয় শাসনব্যবস্থার বিকল্প ছিল না। জাতীয় সংহতি ও উন্নতি বিধানে এ ব্যবস্থার প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে বাকশাল আর আলোর মুখ দেখেনি। ফলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের গতি ভিন্নভাবে প্রবাহিত হয়।