বাঙালির নৃতাত্বিক পরিচয় দাও।

 

অথবা, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দাও।

অথবা, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পটভুমি তুলে ধর।

উত্তরঃ ভূমিকা: জীব হিসেবে মানুষ সম্পর্কিত বিদ্যা বা বিজ্ঞান হলো নৃতত্ত্ব। নৃতত্ত্ব মানব নীতির দৈহিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক সকল দিক নিয়ে চর্চা করে। মানব দেহের আকৃতি কীভাবে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হলো, মানবজাতির মধ্যে কীভাবে বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা ও জাতির উদ্ভব হলো এসব বিষয় নিয়ে নৃবিজ্ঞান আলোচনা করে। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ও এ বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে বের করা হয়। সাধারণত তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করা হয়। যথা।

১. প্রাচীনতম মানুষের বাঙালিত্ব,

২. জাতি ও উপজাতি সম্পর্কে প্রাচীন সাহিত্য ও ঐতিহাসিক নজির এবং

৩. বর্তমান কালের জাতিগুলোর নৃতত্ত্বমূলক বৈজ্ঞানিক পরিমাপ। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের পূর্বে বাঙালি কারা তা জানা প্রয়োজন।

বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়: বাংলা ভাষায় কথা বলে এমন এবং এক বিশিষ্ট সংস্কৃতির ধারক যে জনসমষ্টিতারাই বাঙালি নামে পরিচিত। ড. অতুল সুর বলেন, “বাঙালি বলতে আমরা মাত্র তাদেরই বুঝি যাদের মাতৃভাষা বাংলা এবং যারা বাংলাদেশের এক বিশেষ সংস্কৃতির বাহক।” এর মাধ্যমে বুঝা যায়, বাঙালির নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে।

বাঙালি সংকর জাতি: বাংলা ভাষার মতো বাঙালি জাতিও মিশ্র বা সংকর।নীহাররঞ্জন রায় বলেন, “বাঙালি এক সংকর জাতি এর থেকে বুঝা যায়, বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে বাঙালি জাতির উদ্ভব হয়েছে। বাঙালি জাতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা দর্বার শ্রোতে এলো কোথা হতে সমুদ্রে হলো হারা।

অনেক জাতির সংমিশ্রণে বাঙালি জাতি গঠন হয়েছে। তবে কোন কোন জাতির সমন্বয়ে বাঙালি জাতি গঠিত হয়েছে, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।

ড. আহমদ শরীফের মতে, “মোটামুটিভাবে বলা যায় নেগ্রিটো, আদি-অস্ট্রেলীয় (ভেজ্জিড) ও মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠীর মিশ্রণ ঘটেছে বেশি। তাই শতকরা ষাট ভাগ অস্ট্রেলীয়, বিশ ভাগ মোঙ্গলীয়, পনেরো ভাগ নেগ্রিটো এবং পাঁচ ভাগ অন্য নরগোষ্ঠীর রক্ত মিশেছে বলে অনুমান অসংগত নয়।”

নিষাদ, কোল, মুন্ডা, ভীল, সাঁওতাল, শবর, পুলিড, মালপাহাড়ি প্রভৃতি হচ্ছে তুলনামূলকভাবে অল্প সংকদা আদি অস্ট্রেলীয়। অন্যদিকে, কিরাত, রাজবংশী, নাগা, সেচ, কোচ, সিজার, কুকী, চাকমা, আরাকানী প্রভৃতি হচ্ছে স্বল্প সংকর মোঙ্গলীয়।

এছাড়া চব্বিশ পরগনার বরাচম্পার ও হরিনন্দপুর বা হরিনারায়ণপুর এলাকা কাল প্রবাহে গৌড়, মালব, চীড়, মাক, হুন, কুলিক, কর্ণাট, দ্রাবিড়, লাট, মুন্ডা, কুষাণ, ইউটি, আরব, ইরানি, হাবসি, গ্রিক, তুর্কি, আফগান, মুঘল, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজদের রক্ত মিশ্রিত হয়েছে বাঙালির মধ্যে।

বাংলাদেশের পুত্র, রাঢ়, বঙ্গা, সূক্ষ্ম ছিল প্রধান। অপ্রধানের মধ্যে ছিল কোল, শারব, পুলিন্দ, ডোম, হাড়ি, চণ্ডাল প্রভৃতি।

পশ্চিমবঙ্গের পাণ্ডুরাজার ডিবি উৎখননে আবিষ্কৃত নানা প্রত্ন সামগ্রী দেখে বলা যায়, জৈন ও বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে পরিচয়ের পূর্বেও তিন হাজার বছর আগে এদেশে মানুষ ছিল। এর সাথে তাদের সংস্কৃতিও ছিল। এভাবে বহু জাতির মিশ্রণের ফলে গড়ে উঠা বাঙালির স্বভাব চরিত্র হয়েছে অনন্য।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, বাঙালির আদি মানুষ কবে এখানে বসতি স্থাপন করে তা বলা না গেলেও বাঙালি যে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মিশ্রণে একটি সংকর জাতি তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। তবে কোন কোন জাতির সমন্বয়ে বাঙালি জাতি গঠিত তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।