বাঙালির স্বাধীনতার সোপানসমূহ বর্ণনা কর।

অথবা, বাঙালির স্বাধীনতার সোপানসমূহ উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সুদীর্ঘকালের ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা লাভ করে। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার পিছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। মুঘল আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান শাসনামল পর্যন্ত সবসময়ই বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। অন্যায়, অবিচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে, সর্বদা সোচ্চার এ জাতি। দীর্ঘ পথ ক্রম ও সোপানসমূহের মধ্য দিয়ে লাভ করে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।

বাঙালির স্বাধীনতার সোপানসমূহ: নিচে বাঙালির স্বাধীনতার সোপানসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. ভাষা আন্দোলন: ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন সৃষ্টি হয় তার মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতার বীজবপন হয়। বাঙালিরা ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলে। এ বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঙালি জাতির স্বাধীনতার মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছিল। ১৯৫২ সালের এ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি উপলব্ধি করে যে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলায় উপর ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ চালিয়ে বাঙালি জাতিকে দমন করতে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠে তাতে স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়।

২. ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়: ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংসের যড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বৈষম্য নীতি গ্রহণ করে, তারই প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার জনগণ যুক্তফ্রন্টের পক্ষে ভোট প্রদান করেছিল। যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবি সুদৃঢ় হয়। এ দাবি শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হয়।

৩. ১৯৬২ এর ছাত্র আন্দোলন ও দমনপীড়ন: আইয়ুব খান বাঙালি বিদ্বেষী ছিলেন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর নানাভাবে বাঙালিদের দমন করতে থাকেন। তিনি দৈনিক ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালের শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বের হলে দেখা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করা হয়। এর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলা ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে একে প্রতিহত করে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়।

৪. ছয়দফা দাবি ও আন্দোলন: ছয়দফা দাবি ছিল বাঙালির প্রাণের দাবি। মুক্তির সনদ ছয়দফা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত হলে পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের জনতা এর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ছয়দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দমন করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক নিপীড়ন, গ্রেফতার, নির্যাতন শুরু করে। স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক মুক্তিসহ অন্যান্য দাবি আদায়ে পূর্ব বাংলার জনতা ও ছাত্রসমাজ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। ছয়দফা আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ জোরদার হয়। ছয়দফা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের পথ সুগম হয়।

৫. আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন ছিল পূর্ব বাংলার জনতার জন্য অন্যতম বিজয়। স্বৈরাচারী আইয়ুব খান বাঙালিদের ন্যায়সংগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে থাকে। ছয়দফা দাবিকে দমন করার জন্য আইয়ুব খান আগরতলা মামলা দায়ের করেন। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলায় পূর্ব বাংলার ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, জনতা একত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিসহ আগরতলা মামলা প্রত্যাহার, ছাত্রদের ১১ দফা দাবি আদায়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। এ গণআন্দোলনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভিত নড়ে উঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে রূপ নেয়। গণআন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের অন্যতম মাইলফলক।

৬. ‘৭০-এর নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের বিজয়: ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচনের ফলাফলে পাকিস্তান বিভক্তির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো আসন লাভ করেনি। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি বিজয় লাভ করে। ফলে দুই অঞ্চলের জনগণ দুটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে রায় প্রদান করে। পূর্ব বাংলার জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষে রায় দেয়। আওয়ামী লীগের বিজয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার দাবি সুদৃঢ় হয়।

৭. অসহযোগ আন্দোলন: ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় এবং ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক নির্বাচনেও বিজয়ী হয়। ইয়াহিয়া খানের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নির্বাচনে বিজয়ী দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্ত রের কথা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এ বিজয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী হতভম্ব হয়ে পড়ে। তারা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বিভিন্ন টালবাহানা শুরু করে। ইয়াহিয়া ১ মার্চ ১৯৭১ সালে এক ঘোষণা জারির মাধ্যমে ৩ মার্চ (১৯৭১) অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এর ফলে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের জনতা এ অসহযোগ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন, অফিস আদালত, যোগাযোগ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ফলে পূর্ব বাংলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

৮. ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। বাঙালি জাতি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাঙালিরা স্বাধীনতার জন্য এক রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্য, নিপীড়ন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনতা ধাপে ধাপে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ় করে। বাঙালি জাতি তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হয় তা ছয়দফা, ‘৬৯ গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০ এর নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সফলতা লাভ করে।