বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলতে কী বুঝ?

অথবা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ সংজ্ঞায়িত কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরেই ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদে প্রথম অধিবেশন বসে। দ্বিতীয় দিনে আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭২ সালে ৪ নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হলে এর চারটি মূলনীতি যথা:

১. বাঙালি জাতীয়তাবাদ,
২. সমাজতন্ত্র,
৩. গণতন্ত্র ও
৪. ধর্মনিরপেক্ষতা সংযুক্ত হয়।

জাতীয়তাবাদ: বাঙালি জাতীয়তাবাদ জানার পূর্বে আমাদের জাতীয়তাবাদ জানা প্রয়োজন। যখন কোন জনসমষ্টি ভাষা, কৃষ্টি, সভ্যতা, সাহিত্য, ধর্ম প্রভৃতির আলোকে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং নিজেদেরকে অন্য জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক ভাবে তখন তাকে ঐ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয়।

Prof. Laski বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ হলো একপ্রকার মানসিক ঐক্যবোধের অনুভূতি যা একটি জনসমাজকে অবশিষ্ট মানবসমাজ থেকে পৃথক করে।” Bendick Anderson-এর মতে, “A nationalism as an imagined political community and imagined as both inherently limited and sovereign.”

সুতরাং বলা যায় যে, যখন কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জনগণ নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী জাতীয় জীবন গড়ে তোলার মানসিও অনুভূতি ও অনুরাগকে একত্রিত করে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় তখন জাতীয়তাবাদ বলা হয়।

বাঙালি আতীয়তাবাদ: ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের ৯নং অনুচ্ছেদে বাঙালি জাতীয়তাবাদ কথাটি উল্লেখ রয়েছে। যার উপাদান হলো ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম, ঐতিহ্য, অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রভৃতি সক্রিয় উপাদান হিসেবে কাজ করে।

উপর্যুক্ত উপাদান হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, একই ভূখণ্ডে ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক মিল, সাহিত্য, অধিকাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বী, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একই, স্বার্থের জায়গায়ও একই এজন্য বাংলাদেশের নাগরিকের জনগণ বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি নামে পরিচিত।

বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনা: বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছি।

আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যেসব মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ এ সংবিধানের মূলনীতি হইবে।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি ঘরোয়াভাবে। তাই আমরা বাঙালি। এক বাঙালি যখন কোন আঘাত পায় তখন আমরাও আঘাত পাই।”

বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপট: বাঙালি জাতীয়তাবাদ একদিনে গড়ে উঠেনি। দীর্ঘ ইতিহাস ও বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদের উপাদানের জায়গা এক হওয়ায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে। এর প্রতিফলন হিসেবে দেখা যায় বাঙালি জাতির কয়েকটি স্মরণীয় পদক্ষেপ। যথা।

১. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন।

২. ১৯৫৪ সালের নির্বাচন।

৩. ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন।

৪. ১৯৬৬ সালের ছয়দফা’।

৫. ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান।

৬. ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলা।

৭. ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন।

৮. ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ একদিনে গড়ে উঠেনি। ব্রিটিশ শাসন-শোষণ, পাকিস্তানি আমলের নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, বৈষম্য প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের (পূর্ব বাংলা) জনগণ একই মতাদর্শে অভিভূত হয়ে তাদের যৌথ অনুভূতির প্রকাশ করে, ফলে গড়ে উঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদ।