অথবা, বাঙালিরা কিভাবে পাকিস্তানি সংস্কৃতির আগ্রাসন প্রতিরোধ করে তা বর্ণনা কর।
উত্তরা। ভূমিকা: পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বরাবরই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালায় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগণ। জিন্নাহ থেকে শুরু করে আইয়ুব খানের শাসনামল ছিল সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কাল। কিন্তু বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর এ ষড়যন্ত্র মাথা পেতে নেয়নি, গড়ে তুলেছে দুর্বার প্রতিরোধ, যার মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে পড়ে।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের উদ্ভব: ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হবার পরে ভাষার দ্বন্দ্বে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, উর্দু ভাষা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্ররা জীবন উৎসর্গ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি বর্তমানে বিশ্ব আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। আইয়ুব শাসনামলে তিনি ‘নববর্ষ’ পালন নিষিদ্ধ করেন। এছাড়াও তিনি রবীন্দ্র সংগীতসহ রচনা নিষিদ্ধ করেন। অতঃপর তিনি রেডিও, টেলিভিশনে ভারত থেকে চলচ্চিত্র আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। পূর্ব বাংলার জনগণ বিভিন্ন প্রতিবাদের মাধ্যমে তা প্রতিহত করতে থাকেন।
বাঙালি সংস্কৃতি: সাধারণত বাঙালি সংস্কৃতি বলতে বাঙালি জাতির ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি, আচার-অনুষ্ঠানে, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য প্রভৃতিকে বুঝায়। বাঙালিরা বাংলা ভাষায় কথা বলে, নববর্ষ পালন করে, বাংলায় রচিত রবীন্দ্র সংগীত গায়, কবিতা পড়ে, বাংলা চলচ্চিত্র উপভোগ করে, মাছ-ভাত-ডাল তাদের প্রধান খাবার। তারাই বাঙালি জাতি।
বাঙালি সংস্কৃতির আগ্রাসন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধ: পাকিস্তানি শাসনামলে জিন্নাহ থেকে শুরু কবে আইয়ুব খান বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি নিরুদ্ধ আগ্রাসন গ্রহণ করতে থাকে। কিন্তু বাঙালি জনগণ ছেড়ে কথা বলার পাত্র নয়, বাঙালি জাতি তাদের জবাব দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে দেয়।
নিচে এ সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করা হলো:
১. ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন: পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষের মুখের ভাষা ছিল বাংলা। জিন্নাহ ৫৬ ভাগ মানুষের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে ৭.২% মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে। এতে ছাত্ররা সম্মুখে No, No, No বলে প্রতিবাদ জানায়। এ হীন চক্রান্ত রুখতে গিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে, জীবন উৎসর্গ করে পূর্ব বাংলার ছাত্ররা বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত করে।
২. ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল: ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় ও মুসলিম লীগ পরাজিত হয়। অথচ ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বাঙালিরা মুসলিম লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিল। এর মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই পরিচয় মেলে। বাংলার মানুষ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে না এটাই তার প্রমাণ ছিল।
৩. বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা: বাংলা ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে ছাত্ররা জীবন দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পাশাপাশি ‘বাংলা’কে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। যা বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই প্রতিফলন ছিল।
৪. ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন: ১৯৬২ সালের সংবিধান প্রণয়ন ও বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। তার মধ্যে শরীফ শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করা হয়। এছাড়া এ কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষাকে ব্যয়সাপেক্ষ, ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক, উর্দুকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু ১৯৬২ সালে ছাত্ররা এ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলে।
৫. ১৯৬৬ এর ছয়দফা: শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। পূর্ব বাংলার জনগণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিকে কিভাবে বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে তা এখানে সুস্পষ্ট হয়। যা বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৬. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান: শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের নামে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের তাদের
গ্রেফতার করা হয়। এতে বাঙালি জাতি ক্ষুদ্ধ হয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়ে গশ্চিম পাকিস্তানের গুলি, নির্যাতন, গ্রেফতার উপেক্ষা করে সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে।
৭. ১৯৭০ সালের নির্বাচন: ১৯৭০ সালের আওয়ামী লীগের স্লোগান ছিল “সোনার বাংলা শ্মশান কেন।” এ শ্লোগানের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়ে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে।
৮. “বাংলা নববর্ষ” পালন নিষিদ্ধকরণ: আইয়ুব সরকার এক আদেশবলে “বাংলা নববর্ষ” উদযাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে পূর্ব বাংলার জনগণ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে ও আন্দোলনের মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করার প্রয়াস চালায়।
৯. রেডিও ও টেলিভিশন নিষিদ্ধকরণ: আইয়ুব খান এক আদেশবলে রেডিও ও টেলিভিশন চালানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে ছাত্র-জনতা সবাই আইয়ুব সরকারের বিরোধিতা ও পতনের জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে বিভিন্ন সময়ে।
১০. ভারতীয় বই নিষিদ্ধকরণ: আইয়ুব সরকার ভারতীয় বই আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে বাঙালি জাতি এ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
১১. ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি নিষিদ্ধ: আইয়ুব সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এভাবে আইয়ুব সরকার বাঙালি জাতির উপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালায়। ফলে বাঙালি জাতি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলে।
১২. শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য: পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্র বরাবরই পূর্ব বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য চক্রান্ত করে। তাদের ভয় ছিল বাঙালিরা শিক্ষায় উন্নতি লাভ করলে পাকিস্তানিদের চাকরি ক্ষেত্রে তারা প্রতিয়দী হয়ে উঠবে। ১৯৪৮-১৯৬০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের বাজেটে দেখা যায় প্রতি বছরই পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষার ব্যয় পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিগুণ ছিল। ১৯৬৩ সালের বাজেটে পশ্চিম পাকিস্তানে শিক্ষা বাজেট ছিল ২০৩ কোটি আর পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ৭৬.৫ কোটি।
১৩. একক ভাষা: আইয়ুব সরকার বাংলা ও উর্দুর সংমিশ্রণে একটি একক বর্ণমালা উদ্ভাবনের পক্ষে ছিলেন। এতে বাঙালি জাতীয়তাবাদে আঘাত হানে। বাঙালি জাতি এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বাংলা ও উর্দু মিশিয়ে একটি তথাকথিত জাতীয় ভাষা সৃষ্টির উদ্যোগ, এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের সংশ্লিষ্ট করে Bureau of National Reconstruction প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শাসক গোষ্ঠী তৎপরতা চালায়।
১৪. আরবি শব্দ প্রতিস্থাপনের প্রয়াস: আইয়ুব সরকার রোমান হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে উর্দু এবং আরবি শব্দ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এসরের সংস্কার ও ইসলামিকরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। তবে বাঙালি জাতির মনে তীব্র ঘৃণা জন্মে আইয়ুব সরকারের প্রতিফলে আইয়ুব সরকারের পতন হয়।
১৫. সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলা: বাঙালি জাতি আইয়ুব সরকারের নিষেধ উপেক্ষা করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদযাপন করতে থাকে। বাঙালি জাতি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে আইয়ুব সরকারের ভাড়াটে সন্ত্রাসী দ্বারা অনুষ্ঠানে হামলা চালায়। এভাবে আইয়ুব খান বাঙালি জাতির সংস্কৃতিতে আগ্রাসন ভাব প্রতিষ্ঠা করে।
১৬. বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতা অর্জন: পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পূর্ব বাংলার জনগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু স্বাধীনতার পর পূর্ব বাংলার জনগণ নিপীড়ন, নির্যাতন, অর্থনৈতিক শোষণ ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হতে থাকে। এর সাথে ১৯৫২ সলের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ, ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ ছাত্র আন্দোলন, প্রাদেশিক নিবার্চন ছয়দফা, ১৯৬৯ গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পিছনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক কারণ বিদ্যমান ছিল অন্যতম।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, জিন্নাহ থেকে আইয়ুব সরকার বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ তা রুখে দেয়। ফলে জিন্নাহ ও আইয়ুব সরকারের স্বার্থ হাসিল হয়নি। এর জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ তৈরি হয় বাঙালির সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলন থেকে।