অথবা, বাস্তববাদী দার্শনিক হিসেবে এরিস্টটলের গুরুত্ব মূল্যায়ন কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল ৩৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসের এথেন্স প্রদেশের স্ট্যাগিরা নাম স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাস্তববাদী দার্শনিক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত। মার্কসবাদী দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এরিস্টটলকে তাই প্রাচীন বাস্তববাদী জ্ঞান দর্শনের শীর্ষমণি বলে আখ্যায়িত করেছেন। রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে এরিস্টটল কতকগুলো গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থগুলোর মধ্যে, ‘The Politics’, ‘The Constitution’, The Constitution of Athens’, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তবে তাঁর The Politics’ই সর্বশ্রেষ্ঠ বাস্তববাদী রাষ্ট্রদর্শন। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টি, ওয়ারিংটন (T. Warrington) বলেছেন, “The influence of the politics upon subsequent theory has been very considerable from it and from Plato’s statesman Europe received the first nation of constitutionals.”
বাস্তববাদী দার্শনিক হিসেবে এরিস্টটলের অবদান: প্লেটোর শ্রেষ্ঠ শিষ্য এরিস্টটল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। তাঁর গুরু প্লেটো দর্শনে কল্পনাকে আশ্রয় দিলেও এরিস্টটল বাস্তবতাকে আশ্রয় দিয়েছেন। এরিস্টটলকে বাস্তববানী দার্শনিক বলার কারণ নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান: তিনি সর্বপ্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নীতিশাস্ত্র থেকে পৃথক করে একটি পৃথক বিজ্ঞানের মর্যাদা দান করেন। তিনি গ্রিক রাজনীতির অধ্যয়নে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আরোপ করেন ও একে বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান ‘Master of Science’ বলে অভিহিত করেন। বর্তমান রাষ্ট্রবিজ্ঞান তাঁরই সুচিন্তিত ও বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞার ফলস্বরূপ।
২. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবক্তা: সরকারের ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিতে এরিস্টটল সম্পূর্ণ বিশ্বাসী ছিলেন। শাসনক্ষমতা একজনের হাতে ন্যস্ত থাকলে যে সব কুফল দেখা দেয়, তার আভাষ তিনি দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, একজনের হাতে শাসনক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রের সূচনা অনিবার্য হয়ে পড়ে। তাই তিনি ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবর্তন করে সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা রোধ করতে সচেষ্ট হন।
৩. বিপ্লব তত্ত্ব: প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে তিনি বিপ্লবের যে কারণ নির্দেশ করে গেছেন তা আজও সত্য বলে প্রমাণিত হয়ে আসছে। তাঁর মতে, মানুষ যখন তার ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত হয়, তখনই সে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিপ্লব সম্পর্কিত তাঁর এ ধারণা আজও অম্লান হয়ে আছে। তাছাড়া বিপ্লবের প্রতিরোধ এবং রাষ্ট্র ও সরকারের স্থায়িত্ব রক্ষার যেসব উপায়ের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন তার গুরুত্ব আজও হ্রাস পায় নি। এরিস্টটল তাই যথার্থই একজন বাস্তববাদী দার্শনিক। অধ্যাপক বার্কার বলেছেন, “Aristotle was too rich in adaptability, too poor in original fancy to shine as a star of first magnitude among the creators of new ideas.”
৪. নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তক: এরিস্টটল আইনের শাসন ও শাসনতান্ত্রিক আইনের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁর মতে, নাগরিকদের প্রণীত শাসনতন্ত্রের উপর রাষ্ট্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জনসাধারণের সামমিক কল্যাণ সাধন জনগণের শাসনব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব। কারণ আইন যেখানে শাসন করে না, সেখানে কোন শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে না। সকলের উপরেই আইনের শাসন থাকা আবশ্যক।-
৫. নৈতিকতার প্রসার: এরিস্টটলের মতে, “নাগরিকদের সাহস ও নৈতিকতার প্রসারের উপর রাষ্ট্রের শক্তি নির্ভর করে।” নাগরিকদের নৈতিক অধঃপতন দেখা দিলে সংবিধান যতই উত্তম হোক না কেন, রাষ্ট্রের কাঠামো তাসের ঘরের মতোই ভেঙে যায়। তার এ যুক্তি সর্বকালে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়।
৬. আইনের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা: এরিস্টটল ব্যক্তিগত সার্বভৌমত্বের চেয়ে আইনের সার্বভৌমত্বকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কোন ব্যক্তি দিতে পারে না, তা সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নিহিত থাকে আইনের মধ্যে। এ ধারণা হতে সার্বভৌমত্বের আধুনিক ধারণা জন্মলাভ করে।
৭. শাসনব্যবস্থার উপর অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক প্রভাব: তিনি শাসনব্যবস্থার উপর অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করেন। সরকারের প্রকৃতি এবং স্বরূপ নির্ধারণে তিনি আবহাওয়া ও জলবায়ু, ভৌগোলিক ও
অর্থনৈতিক উপাদানের প্রভাবকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন। এক্ষেত্রে তাকে রুশো ও মন্টেস্কুর পূর্বসূরি বলা হয়।
৮. রাষ্ট্রের লক্ষ্য নির্ধারণে: রাষ্ট্রের লক্ষ্য নির্ধারণে তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের প্রধান ও পবিত্রতম লক্ষ্য হচ্ছে নাগরিকদের জন্য উন্নততর ও কল্যাণকর জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করা, জ্ঞানের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করা ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধন করা। আধুনিক কালের জন্য কল্যাণকর রাষ্ট্রগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক তাই।
৯. শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা: এরিস্টটলের মতে, “শিক্ষার মাধ্যমে আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলা যায়।” একথা আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়ে আছে। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলা। নাগরিকদের জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করা। তাছাড়া ধনী ও দরিদ্রের মাঝে ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি গঠনের যে সুপারিশ তিনি করেছেন তা অত্যন্ত আধুনিক ও যুক্তিসংগত।
১০. সরকারের শ্রেণিবিভাগ: এরিস্টটলই প্রথম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ যিনি রাষ্ট্রের কল্যাণার্থে গুণগত বিচারে সরকারের শ্রেণিবিভাগ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সরকার শুদ্ধভাবে চললে অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে চললে তা কল্যাণকর এবং বিকৃতভাবে চললে জনগণের জন্য অকল্যাণকর। তাঁর শ্রেণিবিভাগ বর্তমানেও সমভাবে প্রযোজ্য।
১১. কল্যাণমূলক রাষ্ট্র: এরিস্টটল সর্বপ্রথম কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা প্রদান করেন। তিনি বলেন, “রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের অন্তর্গত সকলের তথা সকল পরিবারের জন্য উত্তম জীবনযাপন করা। উত্তম জীবনের অর্থ হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ ও সন্তোষজনক জীবন।”
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, এরিস্টটলের দর্শন তৎকালীন সময় এবং এর পরবর্তী সময়ের রাষ্ট্রচিন্তাকে আলোড়িত করেছিল। এর অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি বাস্তবতার আলোকে রাষ্ট্রদর্শনকে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। রাজনীতি অধ্যয়নের একটি নতুন অবয়ব, পরিবেশ ও কৌশল নির্মাণ করেছেন, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে একটি স্বতন্ত্র বিষয়ের মর্যাদা দিয়েছে। মূলত প্লেটোর ন্যায় কল্পনাকে আশ্রয় না করে বাস্তবতার আলোকে রাষ্ট্রদর্শনকে বিশ্লেষণ করার কারণেই তাঁকে বাস্তববাদী দার্শনিক বলা হয়।