ভারতীয় উপমহাদেশে কর্নওয়ালিশ কোডের প্রভাব সংক্ষেপে লিখ।

অথবা, ভারতীয় উপমহাদেশে কর্নওয়ালিশ কোডের প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

অথবা, ভারতীয় উপমহাদেশে কর্নওয়ালিশ কোডের প্রভাব সম্পর্কে কী জান?

উত্তর: ভূমিকা: ভারতীয় উপমহাদেশে কোড অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব কর্নওয়ালিশের। তিনি ১৭৯৩ সালে ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে একটি কোড ঘোষণা করেন। তার বাহ্যিক উদ্দেশ্য মহৎ হলেও ইউরোপের বর্ণবাদী মনোভাবের ধারক ও বাহক হওয়ায় কর্নওয়ালিশের কোড সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। তবে কিছু ক্ষেত্রে কোড তার অজান্তেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।

ভারতীয় উপমহাদেশে কর্নওয়ালিশ কোডের প্রভাব: ভারতীয় উপমহাদেশে কর্নওয়ালিশ কোডের প্রভাবসমূহ ছিল নিম্নরূপ:

১. দেশের আর্থিক সমস্যার উপর প্রভাব: স্বাভাবিক কারণেই কর্নওয়ালিশ কোড অপারেশনের সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ানি মামলা মোকদ্দমার হার বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রত্যেক আদালতে হাজার হাজার মামলা বিচারের অপেক্ষায় পড়ে থাকে। এর প্রতিক্রিয়া পড়ে রাজস্ব সংগ্রহ ও দেশের সার্বিক অর্থনীতির উপর। সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় ছিল মুঘল ভূমি ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া।

২. বিচার ও বিচারকের অবস্থা: এইসময় অতিরিক্ত আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি করে পর্বত প্রমাণ বকেয়া মামলা নিষ্পত্তি করা। কিন্তু তা না করে সরকার বিচার প্রার্থীদের নিরুৎসাহিত করার জন্য ১৭৯৫ সালে মামলার উপর ফি পুনঃপ্রবর্তন করে।

৩. রায়তদের দুর্দশা: জমিদারি অত্যাচার থেকে রায়তদের রক্ষা করার জন্য কর্নওয়ালিশ কোডে বিধান ছিল যে, জমিদার ন্যায্য খাজনার উপরে রায়তের কাছ থেকে আবওয়াব, মাসূখ, মাগন, শদিয়ানা প্রভৃতি নামে কোনো অতিরিক্ত কর সংগ্রহ করতে পারবে না। কৃষি কাজে ব্যবহৃত হয় এমন হালের গরু, লাঙ্গল, বীজ প্রভৃতি ক্রোক করতে পারবে না। এই রকম সমস্যায় রায়তরা জর্জরিত ছিল।

৪. পশ্চিমা সভ্যতার উদ্ভব: কর্নওয়ালিশের কোড বাঙালির সমাজদেহে পশ্চিমা সভ্যতা, নৈতিকতা ও মনোভাব প্রভৃতির অনুপ্রবেশে সাহায্য করেছিল। শহরে সমাজের কিছু মানুষ পাশ্চাত্য নিয়ন-নীতির চর্চায় নিজেদের নিয়োজিত করলে এখানে আধুনিক সমাজের বিবর্তন ঘটে। কোড বাঙালি জাতির পুরাতন স্বভাব চরিত্র পুরোপুরি বদলিয়ে দিতে না পারলেও তা অনেক নতুন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করেছে সন্দেহ নেই।

৫. দেশি অফিসারদের অপসারণ: কর্নওয়ালিশের কোডের মাধ্যমে সমস্ত উচ্চ বেতনের সম্মানিত পদ থেকে দেশি অফিসারদের উৎখাত করা হয়। এর ফলে শত শত দেশি আমলা ও তাদের পরিবার বেকারত্বের বিবর্তনে আবর্তিত হয়।

৬. শহর ও গ্রামের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি: কর্নওয়ােিশর প্রভাবে জেলা সদরগুলো শহরে পরিণত হলে অচিরেই শহর ও গ্রামের মধ্যে সুযোগের ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়।

৭. পত্তনি প্রথার উদ্ভব : বাঙালি সমাজ ব্যবস্থার বিবর্তনে পত্তনি প্রথা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জমিদারি রক্ষার জন্য প্রচলিত আইনকে উপেক্ষা করতো বর্ধমানের মহারাজা। তার জমিদারি অসংখ্য তালুকে বিভক্ত করে চিরস্থায়ীভাবে নগদ সেলামির বিনিময়ে কারেসি খাজনায় ইজারা দেন। এ পত্তনি সরকার ও পশ্চিমাদের মাঝখানে একটি মধ্যস্বত্বের নাম। এতে জমিদারি রক্ষা পায়। ১৮১৯ সালে সরকার পত্তনি প্রথা বৈধ বলে স্বীকার করে নেয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, কর্নওয়ালিশের কোড উপমহাদেশে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সূত্রপাত করেছিল। কারণ এ কোড শ্বেতাঙ্গদের দেয় একচেটিয়া শাসন ক্ষমতা ও রাজস্বের মালিকানা, প্রশাসনে অংশগ্রহণ থেকে দেশীয়দের করে বঞ্চিত। জমিদারদের সমস্ত ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়ে রায়তদের অত্যাচারী জমিদারের শোষণের মুখে ঠেলে দেয়। এরূপ বহুদোষে দুষ্ট ছিল কর্নওয়ালিশের কোড।